ড. ইয়াদ কুনাইবি

আমার খুব কাছের, প্রিয় এক ভাই…আবু মুহাম্মাদ। চিনি বেশ অনেকদিন ধরেই। বড় মনের মানুষ। অসাধারণ আদব ও আখলাক। একবার কাছ থেকে দেখার পর ভালো না-বেসে থাকা কঠিন।

তাঁর এক ভাই আছে। দুঃখজনকভাবে তার স্বভাব আবু মুহাম্মাদের ঠিক বিপরীত। জর্দানেই কাজ করতেন একজন মিসরীয় ভাই। কোনো এক কারণে কোনো একদিন সেই মিসরীয়কে অপমান করল আবু মুহাম্মাদের ভাই। দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে উপস্থিত মানুষের সামনে সেই মিসরীয় অভিযোগ জানাল, ‘একজন মানুষের সম্বল কেবল তার আত্মসম্মান। আমরা গরিব। মিসর থেকে এখানে এসেছি পেটের দায়ে, কাজ করতে। এ দেশে আমাদের কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই। কোনো অভিভাবক নেই। নিজের বলতে আছে শুধু এই আত্মসম্মান। যদি এও হারিয়ে যায়, তবে আমি আর জর্দানে থাকতে চাই না। এর চেয়ে সম্মান নিয়ে মিসরে ফিরে যাওয়াই ভালো।’ বুকভরা ব্যথা নিয়ে টলোটলো চোখে কথাগুলো বলছিলেন মিসরের সেই ভাই।

জন্মভূমির অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে বাধ্য হয়ে মানুষটা আজ ভিনদেশে। আর দশজনের মতো তিনিও চান নিজ পরিবার-পরিজনের সাথে নিজের ভিটেমাটিতে থাকতে। তিনি ফিরে যেতে চান। কিন্তু জীবিকার তাগিদে থাকতে হয়। অসুস্থ বাবা-মায়ের ওষুধের খরচ, সন্তানদের পোশাক আর খাবারের খরচের চিন্তা তাঁকে ফিরতে দেয় না। প্রতিনিয়ত নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে পড়ে থাকতে হয় এ বিদেশ-বিভুঁইয়ে। তাঁর কথায় ক্ষোভ ছিল না, অভিযোগ ছিল না। ছিল শুধু অশ্রুভেজা দীর্ঘশ্বাস, আর প্রগাঢ় কষ্ট। একসময় আবু মুহাম্মাদের কানে কথাগুলো পৌঁছল। জানতে পারলেন তাঁর ভাই এক মিসরীয়কে অপমান করেছে। আবু মুহাম্মাদ মিসরীয় লোকটির কাছে গেলেন।

‘আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।’

‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ ওয়া বারাকাতুহু’, জবাব দিল ক্লান্ত চোখের মিসরীয়।

বাম পায়ের জুতোটা খুলে মিসরীয় মানুষটার হাতে তুলে দিলেন আবু মুহাম্মাদ। জুতো হাতে নিয়ে অবাক, অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল লোকটি। মিসরীয় মানুষটার একদম সামনে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়ালেন আবু মুহাম্মাদ।

তারপর বললেন, ‘আমি শুনেছি অমুক ব্যক্তি আপনাকে অপমান করেছে। এ জুতো দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করুন এবং আপনার হক আদায় করে নিন।’

‘না ভাই! আমি কেন তা করতে যাব? আর এর সাথে আপনার সম্পর্কই-বা কী?’—লোকটি বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল।

শান্ত, নরম গলায় আবু মুহাম্মাদ জবাব দিলেন, ‘যে আপনাকে অপমান করেছে, আমি তার ভাই। আমি শুনেছি আপনি বলেছেন—আমাদের নিজের বলতে আছে শুধু এই আত্মসম্মান; যদি এটাও হারিয়ে যায়, তাহলে আমি আর জর্দানে থাকতে চাই না। ভাই আপনি জর্দানে মাথা উঁচু করে থাকবেন। আপনার সম্মান অটুট থাকবে। আমরা এখানে সবাই আপনার ভাই। কেউ আপনাকে আর অপমান করার স্পর্ধা দেখাবে না।’

মিসরীয় মানুষটার কাঁপাকাঁপা হাত থেকে পড়ে গেল জুতোটা। এক ঝটকায় আবু মুহাম্মাদকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। চুমু খেলেন তাঁর মাথায়। ইমান ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের এ দৃষ্টান্ত দেখে তাঁর চেহারা আর মন থেকে দূর হয়ে গেল দুঃখের সব ছাপ।

আবু মুহাম্মাদের আচরণে তিনি কুরআনের এ আয়াতের বাস্তবায়ন দেখলেন,

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ

‘মুমিনরা তো পরস্পর ভাই ভাই।’ [সুরা আল-হুজুরাত, ৪৯ : ১০]

আল্লাহ আবু মুহাম্মাদকে হিফাযাত করুন, তাঁকে হিদায়াতের ওপর অটল রাখুন। আমি ইচ্ছে করেই আবু মুহাম্মাদের পুরো নাম বললাম না। আমি জানি জর্দানে তাঁর অনেক অনুসারী রয়েছেন। পুরো নাম বললে সবাই তাঁকে চিনে ফেলবেন।[১]

প্রিয় ভাইয়েরা, আমরা যদি আমাদের প্রবাসী কিংবা উদ্বাস্তু মুসলিম ভাইদের সাথে ভালো ব্যবহার করি, তাঁদের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা পোষণ করি, কষ্টের সময় তাঁদের পাশে দাঁড়াই, তবে সেটি তাঁদের প্রতি আমাদের মহানুভবতা নয়; বরং এগুলো আমাদের দায়িত্ব। এ কাজগুলো ইবাদাত। এই ইবাদতের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করি। আল্লাহর কসম, আমরা সবাই ভাই। মানুষের বানানো সীমান্তের কোনো মূল্য আমাদের কাছে নেই। জাতীয়তাবাদী সীমান্ত আমাদের ভালোবাসার মাপকাঠি নয়। শত্রু যখন উম্মাহর দেহে ছুরি চালায়, তখন আমাদের দায়িত্ব হলো সদাচরণ ও উত্তম আখলাকের মাধ্যমে সেই ক্ষতের পরিচর্যা করা। শত্রুর ফাঁদে পা দিয়ে মানুষের বানানো সীমান্ত আর ঘৃণ্য জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে দলে দলে বিভক্ত হওয়া আমাদের কাজ নয়। আমরা মুসলিম, এটিই আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয়। আর যে অপরাধী, তার বিচার হবে তার অপরাধ অনুযায়ী। তার জন্ম, গোত্র কিংবা জাতীয়তা অনুযায়ী নয়। আমরা আল্লাহর কাছে দুআ করি, তিনি যেন উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করে দেন, আমাদের অবস্থা সংশোধনের সুযোগ দেন।

____________

[ সংগ্রহসূত্র : আয়নাঘর ]

ভাষা-সম্পাদনা : অনুবাদ ও সম্পাদনা পর্ষদ

টীকা

[১] আবু মুহাম্মাদ আসিম বিন মুহাম্মাদ বিন তাহির আল-বারকাওয়ি। মূলত তিনি আরবের উতাইবা গোত্রের লোক। ১৩৭৮ হিজরিতে (১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দ) ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের নাবলুসে তাঁর জন্ম। [সম্পাদক]

Leave a Reply