ভালো মানুষ হওয়ার জন্য কি ধার্মিক হওয়া প্রয়োজন? 

ড্যানিয়েল হাকিকাতযু 

ভালো মানুষ হওয়ার জন্য কি ধর্ম দরকার?  

না। ভালো মানুষ হওয়ার জন্য ইসলাম দরকার।  

হাঁ, অন্য ধর্মের এমন অনেক মানুষ আছে যারা বিভিন্ন ভালো কাজ করে। কিন্তু ‘ভালো’ শব্দটা আমি এখানে একটা বিশেষ অর্থে ব্যবহার করছি। ভালো বলতে আমি বোঝাচ্ছি, এমন মানুষ যে তার মৌলিক নৈতিক দায়িত্বগুলো পালন করে। আর সেগুলো পালন না-করতে পারলে কমসেকম অনুশোচনা বোধ করে। মুসলিমরাই শুধু মৌলিক নৈতিক দায়িত্বগুলো পালন করার অবস্থানে আছে, এই কথা আজ হজম করা কঠিন। মানুষের মধ্যে আজ ব্যাপকভাবে সর্বজনীনতাবাদের যেসব ধ্যানধারণা ছড়িয়ে পড়েছে, এ কথা সরাসরি তার বিরুদ্ধে যায়। ‘ধর্ম পালন না-করেও ন্যায়পরায়ণ হওয়া যায়’, এ কথাকে আজকাল অনেকটা স্বতঃসিদ্ধ সত্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু আসলেই কি তা সত্য?  

এ ধরনের দাবিদারেরা সীমিত কিছু নৈতিক সত্যের ওপর ফোকাস করে থাকেন। যেমন–  

খুন খারাপ, এটা জানার জন্য স্রষ্টাকে লাগে না 

ধর্ষণ খারাপ, এটা বোঝার জন্য স্রষ্টাকে লাগে না  

কেবল স্রষ্টার আদেশের কারণে যদি তুমি ধর্ষণ আর খুন থেকে বিরত থাকো, তাহলে এটা প্রমাণ করে তুমি আসলে কত অনৈতিক…ইত্যাদি।  

আরও বলা হয়–  

আমি কারও ক্ষতি করছি না। এটাই আমার নীতি। এই নীতি মেনে চলার জন্য আমার আল্লাহকে দরকার নেই। ইসলামেরও দরকার নেই।  

আসলে এটা খুব অস্পষ্ট একটা কথা। ক্ষতির অর্থ এখানে স্পষ্ট নয়। ক্ষতির সংজ্ঞা অনেক সময় প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভর করে। সময়, সংস্কৃতি এমনকি ব্যক্তিভেদে ক্ষতির ধারণা আলাদা হতে পারে। কাজেই সবাই যদি মেনেও নেয়, নৈতিকতার মানে কেবল ক্ষতি প্রতিরোধ করা, তবুও ক্ষতির সংজ্ঞা আর অর্থ নিয়ে ব্যাপক মতপার্থক্য থেকে যাচ্ছে। কীসে ক্ষতি হচ্ছে কিংবা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে কোন জিনিসে ক্ষতি সর্বোচ্চ বা সর্বনিম্ন হচ্ছে, সেটা হিসেব করাও সহজ নয়। তা ছাড়া মানুষের বাস্তব জীবনের কর্মকাণ্ড দেখেও এটা মনে হয় না যে প্রত্যেক পরিস্থিতিতে মানুষ লাভক্ষতির জটিল অংশ কষে সিদ্ধান্ত নেয়; বরং অধিকাংশ মানুষ অধিকাংশ সময় বিদ্যমান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি, প্রথা এবং গ্রহণযোগ্য আচরণের সীমার ভিত্তিতে কাজ করে। আর যা কিছু এর বাইরে পড়ে সেটাকে ‘ক্ষতিকর’ ধরে নেয়া হয়।  

এগুলো ‘হার্ম প্রিন্সিপাল’ নামে পরিচিত নীতির বিরুদ্ধে উত্থাপিত আপত্তি। আদতে হার্ম প্রিন্সিপাল হলো নৈতিকতার মোড়কে ক্ষণস্থায়ী সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতার প্রকাশ। ইসলামি নৈতিকতা অনেক সমৃদ্ধ, অনেক বেশি সূক্ষ্ম এবং লিবারেলদের প্রচার করা এই ভাসাভাসা হার্ম প্রিন্সিপালের চেয়ে অনেক গুণে শ্রেষ্ঠ।  ইসলামি নৈতিকতার কেন্দ্রে আছে আদাব এবং আখলাকের ধারণা। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,   

‘তোমাদের মাঝে ওই ব্যক্তি সর্বোত্তম, যার চরিত্র সর্বোত্তম।’  

নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশংসা করে আল্লাহ বলেছেন,  

‘আর নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের ওপর অধিষ্ঠিত।’ [সুরা আল-কলাম ৬৮ : ৪] 

ইসলামি আদাব-আখলাকের এমন অনেক দিক আছে, পশ্চিমা লিবারেল সামাজিক-সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে যেগুলোকে একেবারেই সহজাত মনে হয় না। কয়েকটা উদাহরণ দেখা যাক–  

১। বাবা-মায়ের সম্মান করা এবং দেখাশোনা করার গুরুত্ব  

২। প্রতিবেশীকে সাহায্য করা নৈতিক দায়িত্ব  

৩। অনাথ ও গরিবদের সাহায্য করার গুরুত্ব  

৪। পারিবারিক সম্পর্ক বজায় রাখা নৈতিক দায়িত্ব  

এই মূল্যবোধগুলোর জীর্ণশীর্ণ কিছু রূপ অন্য ধর্মে ও সংস্কৃতিতে এখনো দেখা যায়। কিন্তু ইসলামে এগুলো নিছক ‘ভালোমানুষী’ নয়, বরং দায়িত্ব। এগুলো পালন করলে আপনাকে নৈতিকভাবে অনুসরণীয় মানুষ ধরা হবে না। এটুকু করার অর্থ আপনি প্রাথমিক নৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন। এ দায়িত্বগুলো পালনে আপনি নৈতিকভাবে দায়বদ্ধ। এটা একটা বড় পার্থক্য। 

কিন্ত ইসলামি নৈতিকতার আরও নানা দিক আছে।  

১। কেউ যদি হিংসায় পরিপূর্ণ হয় তাহলে কি সে নৈতিক, ন্যায়পরায়ণ মানুষ বলে গণ্য হবে?  

২। কেউ গিবতে অভ্যস্ত হলে তাকে কি ন্যায়পরায়ণ ও নীতিবান বলা যাবে?  

৩। কেউ যদি মানুষের ব্যাপারে সুধারণা না-রাখে, তাহলে কি তাকে ন্যায়পরায়ণ বলা যাবে? 

৪। কেউ সত্যমিথ্যা যাচাই না-করে যা শোনে তা-ই প্রচার করে বেড়ালে তাকে কি ন্যায়পরায়ণ বলা যাবে?  

৫। কেউ সুদি লেনদেনে যুক্ত। তাকে কি ন্যায়পরায়ণ বলা যাবে? 

ওপরের প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর হলো, না। এ বৈশিষ্ট্যগুলো যদি কোনো মানুষের মাঝে থাকে এবং সে যদি এ কারণে লজ্জা ও অনুশোচনা বোধ না-করে, নিজেকে সংশোধনের চেষ্টা না-করে, তাহলে তাকে ন্যায়পরায়ণ, নীতিবান ব্যক্তি বলা যাবে না। তাহলে যে মানুষ এই দায়িত্বগুলোর ব্যাপারে জানেই না, সে কীভাবে এগুলো মেনে চলবে? গিবত, ঈর্ষা কিংবা বাবা-মায়ের সেবার মতো বিষয়গুলো নিয়ে নাস্তিকদের আপনি  কথা বলতে দেখবেন না। তাদের নৈতিকতার আলাপ শুধু খুন আর ধর্ষণে সীমাবদ্ধ।  

আসলে ওপরে বলা সবগুলো পয়েন্টের ফোকাস হলো অপরের প্রতি নৈতিক দায়িত্ব। আর অপরের প্রতি দায়িত্বের আগে আসে স্রষ্টার প্রতি দায়িত্ব। কাজেই স্রষ্টার প্রতি দায়িত্ব যারা অস্বীকার করে তারা নৈতিক হতে পারে না। তবু তর্কের খাতিরে অপরের প্রতি নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে আলোচনাকে সীমাবদ্ধ রাখলেও লিবারেল-সেক্যুলারদের নৈতিকতার বুঝ অত্যন্ত সংকীর্ণ, সীমিত এবং ত্রুটিপূর্ণ মনে হয়। কেউ হয়তো বলতে পারে, ওপরের এ বিষয়গুলো সাথে নৈতিকতার সম্পর্ক নেই। যেমন, বাবা-মাকে সম্মান করা আসলে নৈতিক দায়িত্ব না। তাহলে প্রশ্ন আসবে, কোনো কিছু নৈতিক কি না, সেটা কীভাবে ঠিক করা হবে? অর্থাৎ আমাদের তখন মেটা-এথিক্সের  আলোচনার গভীরে প্রবেশ করতে হবে।  

এ ক্ষেত্রে একটা সম্ভাব্য অবস্থান হলো, সব ধরনের নৈতিক দায়িত্বের ব্যাপারে সংশয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা। এটা মরাল নায়ালিস্টদের  অবস্থান। ‘বাবা-মাকে সম্মান করাকে কেন নৈতিক দায়িত্ব মনে করতে হবে’, এই প্রশ্ন করা গেলে ‘অপরের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকাকে কেন নৈতিক দায়িত্ব মনে করতে হবে’, সে প্রশ্নও করা যায়। এই প্রশ্নের জবাবে সেক্যুলার ও নাস্তিকদের কাছে কোনো সন্তোষজনক উত্তর তো দূরে থাক সংগতিপূর্ণ উত্তরও নেই।  

নৈতিকতার দর্শন নিয়ে পশ্চিমা অ্যাকাডিমিয়ার আলোচনার দিকে তাকান। একদম প্রাথমিক প্রশ্নগুলোর ব্যাপারেও কোনো ঐকমত্য সেখানে নেই। প্রতিটা বিষয়ে মতপার্থক্য। তাদের বিভ্রান্তি স্পষ্ট। আসলে নৈতিকতার আলোচনায় নাস্তিক ও সেক্যুলাররা হিসেবের মাঝে আসার অবস্থাতেই নেই। সে তুলনায় অন্য আস্তিকদের অবস্থা কিছুটা ভালো। ইসলামের মতোই খ্রিষ্টান ও ইহুদি ধর্মেও স্রষ্টা, মহাবিশ্ব এবং মানবজাতির ব্যাপারে একটা সার্বিক ব্যাখ্যা দেয়া হয়। নৈতিকতা আর দায়িত্বের ভিত্তি ও তাৎপর্য গড়ে ওঠে এই ব্যাখ্যা এবং বিশ্বাসের ওপর। এর মাঝে কোনটি সবচেয়ে সংগতিপূর্ণ ও সন্তোষজনক সেটা পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে।  

ইহুদি ও খ্রিষ্টীয় নৈতিকতার দিকে তাকালে দেখা যায়, সেগুলো বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। বিশেষ করে গত ৫০ থেকে ১০০ বছরে। যেমন সমকামী আচরণ তারা একরকম মেনে নিয়েছে। এ ব্যাপারে ইহুদি ও খ্রিষ্টান ধর্মের বিভিন্ন শাখাকে এখন তেমন একটা আপত্তি করতে দেখা যায় না। সেক্যুলারিজম, লিবারেলিজম এবং ক্যাপিটালিজমের মতো প্রভাবশালী সামাজিক শক্তিগুলোর অনুকরণে, সেগুলোকে জায়গা করে দিতে গিয়ে পরিবার ও পারিবারিক সম্পর্কের ব্যাপারেও তাদের ধর্মীয় এবং নৈতিক অবস্থানে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনকে কীভাবে বৈধতা দেয়া যায়? নৈতিক অগ্রগতির যুক্তিতে? সভ্যতার যত অগ্রগতি হবে নৈতিকতারও তত পরিবর্তন হবে? এমন কিছু? আচ্ছা, সভ্যতার অগ্রগতির মানে কী? যে আচরণকে আজ থেকে ১০০ বছর আগে ঘৃণ্য, জঘন্য মনে করা হতো, আজ সেটাকে গ্রহণযোগ্য কিংবা অনেক ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় মনে করা হচ্ছে–নৈতিকতার এমন ‘অগ্রগতি’র মানেই-বা কী?  

এসব প্রশ্নের উত্তর অধিকাংশ ইহুদি-খ্রিষ্টানের কাছে নেই। আধুনিকতার সাংস্কৃতিক আধিপত্যের কাছে তারা নতি স্বীকার করেছে। ইসলামই কেবল এই চাপ প্রতিরোধ করে আজও নিজের আদি ও অকৃত্রিম অবস্থান বজায় রেখেছে। এ কারণেই ইসলামকে নৈতিকভাবে সেকেলে ও পশ্চাৎপদ মনে করা হয়। কিন্তু ইসলামকে পশ্চাৎপদ কেবল তখনই মনে হবে যখন আপনি মাপকাঠি হিসেবে নেবেন গত ১০ কিংবা ২০ বছরের পশ্চিমা সংস্কৃতিকে। এই মাপকাঠি অনুযায়ী ২০০০ বছর এমনকি ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের আগের পুরো ইতিহাসকেই অনৈতিকতার অন্ধকারের নিমজ্জিত মনে হবে। ইতিহাসের ব্যাপারে এটা অত্যন্ত উদ্ভট এবং উদ্ধত দৃষ্টিভঙ্গি।  

স্রষ্টা, মহাবিশ্ব ও মানবজাতির ব্যাপারে ইহুদি এবং খ্রিষ্টধর্মের দেয়া সার্বিক ব্যাখ্যা নিয়েও পর্যালোচনা করা যায়। সেই বিস্তারিত আলোচনা এই সংক্ষিপ্ত লেখাতে করা সম্ভব নয়। তবে কিছু বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে। যেমন খ্রিষ্টধর্মের ক্ষেত্রে ট্রিনিটির ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা যায়। অন্যদিকে ইহুদি ধর্মের থিওলজির বড় একটা অংশ বারোশো শতাব্দীর ইসলামি কালামি চিন্তাধারা থেকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। ইসলামি স্পেনে যেসব ইহুদি ধর্মতাত্ত্বিক কালামি চিন্তা দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে তাদের মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো মুসা বিন মাইমুন বা মায়মোনেডেস।  

ইসলাম নিয়ে আজকের মূল আপত্তি কী?  মূল আপত্তি হলো, কুরআন আর সুন্নাহতে এমন অনেক কিছু আছে, যা পশ্চিমা লিবারেল-সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে সমস্যাজনক। আপত্তি হিসেবে এটা বেশ দুর্বল। ইসলামি আইনের যে দিকগুলো আজকে আপত্তিকর মনে হচ্ছে, আজ থেকে ১০, ২০ কিংবা ১০০ বছর আগে তার অনেকগুলোকে সমস্যাজনক মনে করা হতো না। একমাত্র নৈতিক অগ্রগতির ভাসাভাসা ধারণার অজুহাত ছাড়া আর কোনো যুক্তি লিবারেল-সেক্যুলার কিংবা নাস্তিকদের কাছে নেই। নৈতিক অগ্রগতি মানে আসলে কী, সময়ের সাথে কীভাবে মানবীয় প্রকৃতির ব্যাপারে নৈতিক সত্য বদলায়–এসব প্রশ্নের কোনো উত্তরও তাদের কাছে নেই।  

দিনশেষে স্রষ্টা, মহাবিশ্ব ও মানবজাতির ব্যাপারে দেয়া ইসলামের ব্যাখ্যা সবচেয়ে সন্তোষজনক। সুস্থ বিবেক ও আকলের অধিকারীরা ইসলামি নৈতিকতার ব্যাপারে আরও বিস্তারিত অনুসন্ধান করে দেখতে পারে। এই পরিপূর্ণ দ্বীন অনুসরণের সুফল  মুসলিমরা এ দুনিয়াতে উপভোগ করে এবং আখিরাতেও করবে বিইযনিল্লাহ। এই অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যে অমুসলিমরা ইসলামে আমন্ত্রিত। আর তারা যদি এতে আগ্রহী না হয় তাহলে আমরা বলব—লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন। 

_______ 

[ সংগ্রহসূত্র : সংশয়বাদী ]