আকিদাহপাঠ : গুরুত্ব ও ক্রমবিকাশ  

 উসতায শাইখুল ইসলাম  

মানবজাতির সৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল মহান আল্লাহর ইবাদত-আনুগত্য, যারা পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবে। প্রথম মানব আদাম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টির আগে আল্লাহ মালাকদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘আমি পৃথিবীতে খলিফাহ (প্রতিনিধি) বানাব।’ (আল-বাকারাহ, আয়াত : ৩০)। খলিফাহ বা প্রতিনিধির কাজ হলো, যে তাকে নিয়োগ দিয়েছে তাঁর নির্দেশনামতো কাজ করা ও অবাধ্যতা না-করা। উক্ত আয়াত থেকে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য প্রমাণিত হয় যে, সৃষ্টিকর্তার অবাধ্যতা না-করে তাঁর প্রতি ইমান রাখা, তাঁর রাজত্ব, কর্তৃত্ব ও বৈশিষ্ট্যে কাওকে অংশীদার না-করা এবং সার্বিক বিষয়ে তাঁর আনুগত্য করা। আল্লাহ মানুষ সৃষ্টির পর সৃষ্টির উদ্দেশ্যটি আরও স্পষ্টভাবে তাদের জানিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘আমি জিন ও মানুষকে কেবল আমার ইবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি।’ (আয-যারিয়াত, আয়াত : ৫৬)। আর এই ইবাদত হলো তাওহিদের গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। ইবাদতে আল্লাহর একত্ববাদ সাব্যস্ত করাকেই তাওহিদুল ইবাদাহ বলে, যা ইসলামি আকিদাহর মৌলিক ও প্রধানতম অংশ। সারকথা হলো, একমাত্র বিশুদ্ধ আকিদাহর জন্যই আল্লাহ মানবজাতিকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তাই, তিনি মানবসৃষ্টির সূচনা থেকে অসংখ্য নবি-রাসুল পাঠিয়েছেন এই আকিদাহ ও তাওহিদকে ধারণ ও প্রতিষ্ঠার জন্য।  

আল্লাহর রুবুবিয়াহ, উলুহিয়াহ, আসমা ও সিফাত, মালায়িকাহ, আসমানি কিতাবাদি, নবি-রাসুল, আখিরাত, তাকদির, গাইবের প্রমাণিত বিষয়াদি, সালাফদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত, আল্লাহর নির্দেশিত বিষয়াদিতে পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইত্তিবা এ সবকিছুতে দৃঢ় ইমান রাখার নাম আকিদাহ। আকিদাহ শব্দটির ব্যবহার ইসলামের প্রথম যুগে ছিল না। তখন উক্ত বিষয়গুলোর প্রতি ইমান রাখা বোঝাতে ভিন্ন কিছু শব্দ ব্যবহার করা হতো। যেমন, আস-সুন্নাহ, আল-ইমান, আশ-শারিয়াহ, আত-তাওহিদ, আল-ফিকহুল আকবার ইত্যাদি। মূলত পূর্ণ শরিয়াতকেই ইসলামি আকিদাহর অন্তর্ভুক্ত গণ্য করা হয়। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে গুরুত্বের বিবেচনায় এর বিভিন্ন অংশকে বিভিন্ন নামে নামকরণ করা হয়ে থাকে। 

আকিদাহ ছাড়া কোনো আমল বিশুদ্ধ হয় না এবং তা উপকারও করে না। বান্দার সর্বপ্রথম দায়িত্ব আকিদাহ বিশুদ্ধকরণ। যেমন, সহিহ বুখারিতে বর্ণিত হয়েছে, মুয়ায বিন জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহুকে ইয়ামানে পাঠানোর সময় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন—তাদের প্রতি তোমার প্রথম আহ্বান হবে, তারা যেন আল্লাহর একত্ববাদকে মেনে নেয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতেও আমরা দেখতে পাই, তিনি আমল শেখানোর আগে মানুষকে তাওহিদ ও আকিদাহ শিখিয়েছেন। এমনকি মক্কার তের বছরের সময়কালে তেমন কোনো বিধিবিধানও দেয়া হয়নি। মাক্কি সুরাগুলোর প্রায় সকল আলোচনাই তাওহিদ ও আকিদাহ নিয়ে। যেহেতু আকিদাহ এমন এক ভিত্তি, যার ওপর মানুষের সকল আমল কবুল হওয়া নির্ভর করে, তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আকিদাহ বিশুদ্ধকরণ।  

ইসলামের ইতিহাসে সাহাবিযুগ ছিল সোনালি যুগ। তাঁরা সবাই একই মানহাজের ওপর ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। তাবিয়িরাও একই মানহাজের ওপর ছিলেন। তবে সাহাবিযুগের শেষদিকে একাধিক বাতিল আকিদাহর ফিতনা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। দ্বিতীয় খলিফাহ উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর যুগ পর্যন্ত কোনো ফিতনা উঁকি দিতে পারেনি। তাঁর পরে তৃতীয় খলিফাহ উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর সময়ে ফিতনাগুলো মাথাচাড়া দেয়া শুরু করে। চতুর্থ খলিফাহ আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুর সময়ে মুসলিমবিশ্বে মোটামুটি তিনটি বাতিল আকিদাহর আত্মপ্রকাশ ঘটে—খাওয়ারিজ, শিয়া ও কাদরিয়া।[১] সাহাবিযুগের পর হিজরি দ্বিতীয় শতকের শুরুর দিকে ‘জাহমিয়া’ নামক আরেক মারাত্মক ভ্রান্ত আকিদাহর উৎপত্তি হয়। [২] পরে এদের কাছাকাছি সময়েই বিখ্যাত তাবিয়ি হাসান আল-বাসরির (মৃত্যু : ১১০ হিজরি) যুগে মুতাযিলা নামক আরেক বাতিল আকিদাহর জন্ম হয়। তাঁরই বহিষ্কৃত শিষ্য ওয়াসিল ইবনু আতার হাত ধরে এর সূচনা হয়েছিল।[৩] একসময় এরা মুসলিমবিশ্বকে গ্রাস করে ফেলে। এর অন্যতম একটা কারণ, মুসলিমবিশ্বে গ্রিকদর্শনের আমদানি। এটা আগুনে তেল ঢালার মতো কাজ করে। জাহমিয়া ও মুতাযিলাদের উদ্ভট সব বাতিল আকিদাহ যখন উম্মাহর বিশুদ্ধ আকিদাহয় ক্ষত সৃষ্টি করে চলেছে, সে সময় আব্বাসি শাসক মামুনের[৪] প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় এটা আরও ব্যাপক ও ভয়াবহ আকার ধারণ করে মুসলিমসমাজের সর্বস্তরে পৌঁছে যায়। গ্রিকদর্শনের এই প্রলয়ংকরী ঝড়ে ইসলামি আকিদাহ লণ্ডভণ্ড হওয়ার উপক্রম হয়।  

গ্রিক দার্শনিকদের বই-পুস্তক মামুনের যুগেই ব্যাপকভাবে আরবিতে অনূদিত হয়ে মুসলিমসমাজে ছড়িয়ে পড়েছিল। তখন মুতাযিলারা এটা গ্রহণ করে নেয়। হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীর আগে মুসলিমসমাজ এই জ্ঞানের সাথে পরিচিত ছিল না। আবুল ফাতহ আশ-শাহরিস্তানি (মৃত্যু : ৫৪৮ হিজরি, ১০৮৬ খ্রিস্টাব্দ) বলেন, ‘মামুনের যুগে যখন দর্শনশাস্ত্রের বই-পুস্তকগুলো ব্যাখ্যা করা হয় (অনূদিত হয়), তখন মুতাযিলা শাইখরা এগুলো অধ্যয়ন করে। ফলে তারা নিজেদের মানহাজকে দর্শনশাস্ত্রের মানহাজের সাথে মিশিয়ে ফেলে এবং একে একটা আলাদা জ্ঞানের শাস্ত্রে পরিণত করে। আর তারা এর নাম দেয় কালাম।’ (দেখুন : আশ-শাহরিস্তানি, আল-মিলাল ওয়ান নিহাল, খণ্ড : ১, পৃষ্ঠা : ২৯)। মূলত ইসলামি আকিদাহকে দর্শনশাস্ত্রের সাথে গুলিয়ে একে ‘ইলমুল কালাম’ বলে নামকরণ করে প্রথম ওরাই। সালাফদের থেকে এই নামটা প্রমাণিত নয়।   

বলাবাহুল্য, মুসলিমসমাজে এই জ্ঞানের চর্চাটা কোনো প্রয়োজনের তাগিদে হয়নি, বরং খামখেয়ালিবশতই হয়েছে। যেহেতু এটা ওহি নয়, যুক্তিবিদ্যা, তাই তখন এই সুযোগে নিজেদের বাতিল মতবাদকে সাব্যস্তকরণের জন্য মুরজিয়া, শিয়া ও জাহমিয়ারাও এর চর্চায় মনোনিবেশ করে। মুতাযিলারা ইসলামি আকিদাহকে কালাম-শাস্ত্রের উসুল ও যুক্তির মানদণ্ডে নিরীক্ষণ করছিল। কুরআন, অর্থাৎ আল্লাহর কালামকে সৃষ্ট বলে নশ্বর হিসেবে প্রমাণ করছিল। এমনকি আল্লাহর সমস্ত সিফাতকেই অস্বীকার করে বসে। ইমাম বাইহাকি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘মামুনের আগে উমাইয়া ও আব্বাসি বংশের সকল খলিফাহই সালাফদের মাযহাব ও মানহাজের ওপর ছিলেন। সে খিলাফাতের দায়িত্ব নিলে সব মুতাযিলারা এসে ভ্রান্ত আকিদাহগুলো তার কাছে তুলে ধরে।’ (দেখুন : ইমাম ইবনু কাসির, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, খণ্ড : ১৪, পৃষ্ঠা : ৩৯৬)। 

ভয়াবহ এই ফিতনার সামনে পাহাড়সম মনোবল নিয়ে একপায়ে দাঁড়িয়েছিলেন ইমামু আহলিস সুন্নাহ ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু : ২৪১ হিজরি)। তাঁর সাথে আরও যেসব উলামা কিরাম ছিলেন, শাসকের রক্তচক্ষুর সামনে দাঁড়াতে না-পেরে সবাই পিছু হটে গিয়েছিলেন। একমাত্র তিনিই একাকী এই ফিতনার মোকাবেলা করে গিয়েছেন। শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় কালামশাস্ত্র ও মুতাযিলা আকিদাহচর্চা সর্বত্রই হচ্ছিল এবং জোরপূর্বক মানুষকে এই আকিদাহ মানতে বাধ্য করা হচ্ছিল। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল ফাতওয়া দিয়েছিলেন, ‘তোমরা কালামিদের সঙ্গে বসবে না। ওরা যদি কালাম দিয়ে সুন্নাহকে সাহায্য করে তবুও।’ (দেখুন : ইমাম ইবনুল জাওযি, মানাকিবুল ইমাম আহমাদ, পৃষ্ঠা : ২১০)। শেষ পর্যন্ত ইমাম কারাবরণ করে চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। আল্লাহ তাঁর ওপর রহম করুন। একের পর এক লাগাতার তিনজন শাসকের শাসনামলে তিনি প্রতিরোধ চালিয়ে গিয়েছেন।[৫] ফলে একসময় এই ফিতনা খিলাফাতের তত্ত্বাবধান হারিয়ে ফেলে এবং সমাজের ব্যক্তি-পর্যায়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়। কিন্তু ততদিনে উম্মাহর বিশাল এক অংশ এর ধারক-বাহক বনে গিয়েছিল এবং তারা এর চর্চা ও প্রচার-প্রসার চালিয়ে যাচ্ছিল। তাই, তখন এর মোকাবেলায় আরও অনেকেই এগিয়ে আসেন। এঁদের অনেকেই এমন ছিলেন যে, তাঁরাও ইলমুল কালাম চর্চায় মনোনিবেশ করে এ দিয়েই প্রতিপক্ষকে প্রতিরোধ করছিলেন। কিন্তু এটা করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা নুসুসচর্চার মানহাজ থেকে দূরে সরে পড়েছিলেন। 

ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হলো। যুক্তি, পাল্টা-যুক্তি, দর্শন ইত্যাদিই হয়ে গেল ইসলামি আকিদাহ সাব্যস্তের মানদণ্ড। বিরোধীরা আল্লাহর সিফাতের উপর আপত্তি তুলছিল, আর তাঁরা ওদের আপত্তির জবাব দিতে গিয়ে সিফাতের বিভিন্ন তাবিল বা দূরবর্তী ব্যাখ্যা করে যাচ্ছিলেন। এভাবেই আল্লাহর সিফাত আসল অর্থ থেকে বিকৃত হয়ে পড়ে। আবদুল্লাহ ইবনু সায়িদ ইবনি কুল্লাব (মৃত্যু : ২৪১ হিজরি) ছিলেন তাঁদেরই অন্যতম। তিনি ব্যাপকভাবে জাহমিয়া ও মুতাযিলাদের প্রতিরোধ ও খণ্ডনে জোরালো ভূমিকা রাখেন। তাঁর চিন্তা-চেতনাও ছিল কালামনির্ভর। এ জন্য সালাফদের মানহাজে তিনি থাকতে পারেননি। অনেক ভুল চিন্তাধারা তিনি পোষণ করতেন। একসময়ের মুতাযিলা আলিম ইমাম আবুল হাসান আশআরি (মৃত্যু : ৩২৪ হিজরি) মুতাযিলা আকিদাহ ত্যাগ করে ইবনু কুল্লাবের মতবাদ গ্রহণ করেন এবং ইলমুল কালাম দিয়েই মুতাযিলাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালিয়ে যান। তৎকালসহ পরবর্তীকালেও অনেক বিজ্ঞ আলিম কুল্লাবি ধারায় কালামশাস্ত্র দিয়ে জাহমিয়া ও মুতাযিলাদের খণ্ডন করে গিয়েছেন।  

এভাবে নুসুস ও সালাফদের মানহাজ ত্যাগ করে কালামশাস্ত্র দিয়েই কালামিদেরকে খণ্ডন করা ও ইসলামি আকিদাহ সাব্যস্ত করা যে ভুল, সেটা ইমাম আশআরিসহ অনেকেই শেষজীবনে বুঝতে পেরেছিলেন। ফলে সালাফদের মানহাজে তাঁদের প্রত্যাবর্তনটাও ছিল স্বাভাবিক বিষয়। ইমাম আশআরি (রাহিমাহুল্লাহ) শেষজীবনে সালাফদের মানহাজে ফিরে এসেছিলেন এবং নিজেই বলেছেন, ‘আমাদের কথা ও বিশ্বাস অনুযায়ী বক্তব্য হচ্ছে, আল্লাহর কিতাব, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ, নেতৃপর্যায়ের সাহাবি, তাবিয়ি ও হাদিসের ইমামগণ থেকে যা বর্ণিত হয়েছে, সেগুলোকে আঁকড়ে থাকা। আমরা সেগুলো আঁকড়ে ধরে আছি। আর ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল যা কিছু বলেছেন, তা আমরাও বলি। তিনি যাদের মতের বিরোধিতা করেছেন, আমরাও তা এড়িয়ে চলি।’ (দেখুন : আল-ইবানাতু আন উসুলিদ দিয়ানাহ, পৃষ্ঠা : ২০)। 

ইমামুল হারামাইন আল-জুয়াইনি ও তাঁর পিতা আবদুল্লাহ আল-জুয়াইনি, ইমাম ফখরুদ্দিন রাযি, আবুল ফাতহ আশ-শাহরিস্তানি, ইমাম গাযালি প্রমুখও শেষজীবনে কালামশাস্ত্রের অসারতা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। আশ-শাহরিস্তানি ‘নিহায়াতুল ইকদাম ফি ইলমিল কালাম’ বইয়ে নিজেই ইলমুল কালামের নিন্দা করেছেন এবং তা থেকে সতর্ক করেছেন। (আল-জুয়াইনি ও তাঁর পিতার ব্যাপারে জানতে দেখুন, ইমাম আল-জামি লিখিত ‘আস-সিফাতুল ইলাহিয়াহ, পৃষ্ঠা : ১৬৪’)। 

আবদুল্লাহ আল-জুয়াইনির লিখিত ‘রিসালাতু ইসবাতিল ইসতিওয়া ওয়াল ফাওকিয়াহ’ কিতাবটি এ ব্যাপারে খুবই সুস্পষ্ট। তাঁর ছেলে ইমামুল হারামাইন আবুল মাআলি আল-জুয়াইনির লিখিত ‘আল-আকিদাতুন নিযামিয়াহ’ কিতাবেও স্পষ্টভাবে সালাফদের অনুসরণের বিবরণ এসেছে। ইমাম রাযি তো ‘আকসামুল লাযযাত’ বইয়ের একদম শেষে উপসংহারে ইলমুল কালাম থেকে বের হয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছেন। আর ইমাম গাযালিও ‘ইলজামুল আওয়াম আন ইলমিল কালাম’ বইয়ে সুস্পষ্টভাবে সালাফদের মাযহাব হক এবং সালাফের বিরোধীরা বিদআতি বলে ব্যক্ত করেছেন। তিনি ইলমুল কালামকে নিকৃষ্ট বিদআত বলেও উল্লেখ করেছেন।  

তাই, ইসলামি আকিদাহর সাথে ‘ইলমুল কালাম’ নামক গ্রিক দর্শনের সম্পর্ক থাকা তো দূরের কথা; ধর্মীয় ছোটখাটো আমলের সাথেও এর কোনো সম্পর্ক নেই। এটা তো প্রথম যুগেই ইসলামকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে। ইসলামি আকিদাহ ও আমল সাব্যস্ত হয় নুসুস তথা ওহি দিয়ে। কালাম বা যুক্তিবিদ্যার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তাই, আকিদাহকে ‘ইলমুল কালাম’ বলা অজ্ঞতার পরিচায়ক।  

আল্লাহর নাম ও সিফাত, ইমানের সংজ্ঞা ও এর হ্রাস-বৃদ্ধি, আরশের ওপর আল্লাহর সমুন্নত হওয়া, তাকদির এবং পরকালীন অনেক অকাট্য বিষয়াদি, যা ইসলামি আকিদাহর মৌলিক বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত, সেগুলোকে বাতিল ফিরকাগুলো অস্বীকার, বিকৃতি, অপব্যাখ্যা ও অর্থ না-জানার দাবি করে নিজেদের মনমতো মতবাদ প্রচার করেছে। সালাফ উলামা কিরাম বরাবরই ওদের প্রতিরোধ ও খণ্ডন করে গিয়েছেন। এ জন্য তাঁদের অনেকের করুণ পরিণতিও বরণ করতে হয়েছে। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বলের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। ইমাম আহমাদ ইবনু নাসর আল-খুযায়িকে তৎকালীন কালামপন্থী মুতাযিলা শাসক ওয়াসিক বিল্লাহ রাজদরবারে এনে নিজ হাতে হত্যা করেছে। (দেখুন : ইমাম ইবনু কাসির, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, খণ্ড : ১৪, পৃষ্ঠা : ৩১০, দুইশো একত্রিশ হিজরি সনের ঘটনাবলি অধ্যায়)। তবুও সালাফরা থেমে থাকেননি। সাহাবা কিরামের মানহাজে দৃঢ় থেকে ইসলামি আকিদাহকে সংরক্ষণ করতে চূড়ান্ত চেষ্টা করে গিয়েছেন। তাঁদের এতসব কুরবানি, ত্যাগ ও কষ্টের বিনিময়ে ধারাবাহিকসূত্রে বিশুদ্ধ ইসলামি আকিদাহ আমাদের সামনে বিদ্যমান। তাই সালাফদের যারা ‘মা-আনা আলাইহি ওয়া আসহাবি’ তথা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ ও সাহাবিদের মানহাজের ওপর থেকে আকিদাহর চর্চা করে গিয়েছেন, আমরা তাঁদের থেকেই আকিদাহ গ্রহণ করব। তাঁদের বুঝই চূড়ান্ত বুঝ। তাঁদের কাছ থেকেই নুসুস (কুরআন-সুন্নাহ) ও আকিদাহর সঠিক বুঝ নিতে হবে।  

_____ 

টীকা : 

[১] খাওয়ারিজ : হিজরি ৩৭ সনে বর্তমান সিরিয়ার শহর রাক্কার পাশে ফুরাত নদীর তীরে সিফফিন নামক স্থানে আলি ও মুয়াবিয়াহ রাদিয়াল্লাহু আনহুমার মধ্যকার যুদ্ধের পর উভয়েই সালিশ কমিটির হাতে পরবর্তী সিদ্ধান্ত ন্যস্ত করায় আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুর সৈন্যদের একটা অংশ সালিশিতে তীব্র আপত্তি জানিয়ে দল থেকে বেরিয়ে যায়। এদের বেশিরভাগই তামিম গোত্রের ছিল।  ইতিহাসে এরাই খাওয়ারিজ নামে পরিচিত। তৎকালীন খাওয়ারিজদের একটি উপদল যারা ‘ইবাদিয়াহ’ নামে পরিচিত, তারা বর্তমানে ওমানে ক্ষমতাসীন রয়েছে।  

শিয়া : শিয়াদের উৎপত্তি মূলত তৃতীয় খলিফা উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর যুগে। ওরা আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুর প্রতি অতিভক্তি ও দরদকে ঢাল বানিয়ে ইসলামি খিলাফাহ ধ্বংসের নকশা এঁকেছিল। ইয়াহুদি আবদুল্লাহ ইবনু সাবা ছিল এদের প্রতিষ্ঠাগুরু। সে দূরবর্তী শহরগুলোর সাধারণ মুসলিমদের কাছে আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুর ফযিলত-বর্ণনা ও উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর বদলে তাঁকে খলিফা নিয়োগের বিষয়ে মারাত্মক ফিতনা ছড়িয়ে দেয়। পরে ৩৫ হিজরিতে হজের মওসুমে মদিনায় উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর বাড়ি ঘেরাওয়ের মাধ্যমে তাঁকে হত্যা করে আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জোরপূর্বক খিলাফাতগ্রহণে বাধ্য করে। আলি ও মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুমার মাঝে সালিশের জের ধরে এদের একটা অংশ আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুর দল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরও অন্য দলটি তাঁর কাছে থেকে যায়। পরবর্তীকালে উমাইয়াদের শাসনকালে ওরা শিয়ানে আলি বা আলির দল নামে ইতিহাসে পরিচিত হয়। এ থেকেই এদেরকে শিয়া বলা হয়। শিয়ারা প্রচুর দল-উপদলে বিভক্ত। বর্তমানে এদের প্রায় সব দলই কুফরিতে লিপ্ত। বর্তমান বিশ্বে তিন শ্রেণির শিয়া মারাত্মক পর্যায়ের কুফরিতে লিপ্ত। এরা সুস্পষ্ট কাফির। রাফিদাহ, নুসাইরিয়াহ ও বাতিনিয়াহ। রাফিদিরা ইরানে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং ক্ষমতাসীন। এদের ইমামিয়া ও খুমিনিয়াও বলা হয়। এরা বারো ইমামে বিশ্বাসী। নুসাইরিয়ারা সিরিয়াতে ক্ষমতাসীন। তবে ওখানে ওরা সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। আর বাতিনিয়ারা ভারতবর্ষ, ইরান, সিরিয়া ও বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে। এদের ইসমাইলিয়াও বলা হয়। এরা সবাই-ই ভয়ংকর কুফরিতে লিপ্ত। এরা ছাড়াও শিয়াদের আরও অনেক দলের মাঝেই কুফরি বিদ্যমান। তবে এদের কিছু কিছু দল রয়েছে যারা শুধু বিদআতেই সীমাবদ্ধ, কুফরিতে পৌঁছায়নি। তন্মধ্যে ইয়ামানের যাইদিয়া শিয়াদের কিছু কিছু উপদল আছে যারা মুসলিম। এরা শুধু আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুকে আবু বাকর ও উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমার ওপর প্রাধান্য দিয়ে থাকে। অন্য কোনো কুফরি এদের মধ্যে পাওয়া যায় না। তবে বর্তমানে যাইদিয়াদের অবস্থা আল্লাহই ভালো জানেন। 

কাদরিয়া :  এদের আকিদা হলো তাকদির বলতে কিছুই নেই; বরং কোনো কাজ ঘটার পর আল্লাহ তা জানতে পারেন। সর্বপ্রথম এই আকিদাহর সূচনা করে মাবাদ আল-জুহানি। সাহাবিরা ব্যাপকভাবে ওর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ৮০ হিজরিতে তৎকালীন শাসক আবদুল মালিক ইবনু মারওয়ান তাকে শূলীতে চড়িয়ে হত্যা করে। গাইলান আদ-দিমাশকি ওর কাছ থেকে ওই আকিদাহ গ্রহণ করে ছড়িয়ে দেয়। ১০৬ হিজরিতে গাইলান মারা যায়। 

[২] জাহম বিন সাফওয়ান আল্লাহর সিফাত অস্বীকার করেছে এবং ইমানকে অন্তরের জ্ঞানের সাথে আবদ্ধ করে সংজ্ঞায়িত করেছে। ১২৮ হিজরিতে তাকে হত্যা করা হয়। সে উক্ত আকিদাহ গ্রহণ করেছিল জাদ ইবনু দিরহাম থেকে, যাকে ১০৫ হিজরিতে মুসলিমদের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়ানোর দায়ে হত্যা করা হয়েছিল। জাহমিয়াদের উল্লেখযোগ্য আকিদাহ হলো, আল্লাহর ব্যাপারে জানা থাকাই মুমিন হওয়ার জন্য যথেষ্ট, অজ্ঞতা ছাড়া কেউ ইমান থেকে বের হয় না, কাফিরও হয় না, জান্নাত-জাহান্নাম ও এর অধিবাসীরা চিরস্থায়ী নয়, আল্লাহর সকল নাম ও গুণ অস্বীকার করা এবং আল্লাহকে আরশের ওপর অস্বীকার করে সকল স্থানে সত্তাগতভাবে আছেন বিশ্বাস করা। আল্লাহকে দেখাসহ পরকালীন অনেক বিষয়কেই এরা অস্বীকার করেছে।  

[৩] মুতাযিলা মতবাদের জনক ওয়াসিল ইবনু আতা। সে আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুর নাতি আবদুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনিল হানাফিয়ার কাছে পড়াশোনা করার পর বিশিষ্ট তাবিয়ি হাসান আল-বাসরির শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। ওর ভ্রান্ত আকিদাহর কারণে তিনি ওকে মাজলিস থেকে বের করে দেন। ১৩১ হিজরিতে সে মারা যায়। মুতাযিলাদের ভ্রান্ত আকিদাহর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, পরকালে আল্লাহর দর্শনলাভকে অস্বীকার, কালামুল্লাহ তথা কুরআনকে মাখলুক বা সৃষ্ট বলা, কবিরাহ গুনাহকারীর জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুপারিশ অস্বীকার এবং আল্লাহ আরশের ওপর থাকাকে অস্বীকারসহ সত্তাগত সকল সিফাত অস্বীকার করা।  

[৪] আব্বাসি বংশের সপ্তম শাসক মামুনুর রশিদ বাদশাহ হারুনুর রশিদের ছেলে। ১৭০ হিজরিতে বর্তমান তুরস্কের তুরসুসে যুদ্ধরত অবস্থায় মারা যায়। 

[৫] মামুনুর রশিদ (মৃত্যু ১৭০ হিজরি), মুতাসিম বিল্লাহ বিন হারুনুর রশিদ (মৃত্যু ২২৭ হিজরি), ওয়াসিক বিল্লাহ বিন মুতাসিম (মৃত্যু ২৩২ হিজরি)।