ডা. মুর্তজা শাহরিয়ার
বর্তমানবিশ্বে চিকিৎসাশাস্ত্র যেই বিষয়গুলো নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন, তার অন্যতম হলো এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স। সোজা অর্থে একটি ব্যাকটেরিয়া যদি কোনোভাবে একটি নির্দিষ্ট এন্টিবায়োটিক ড্রাগের (ওষুধ) বিরুদ্ধে টিকে থাকে বা টিকে থাকার কৌশল রপ্ত করতে পারে, তখন আর ওই ওষুধে কোনো কাজ হয় না। আর এ ঘটনাকেই আমরা এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বলি।
এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স কীভাবে হয়
হতে পারে একটি ব্যাকটেরিয়া শুরু থেকেই কোনো নির্দিষ্ট ওষুধের বিরুদ্ধে টিকে থাকতে পারে। আবার সে নানাভাবে রেজিস্ট্যান্স তৈরিও করতে পারে। যেমন, নির্দিষ্ট কিছু এনজাইম তৈরি করা, যা ওষুধকে অকার্যকর করে দেবে। নিজ কোষ থেকে ওষুধ বের করে দেয়া, যাকে আমরা ইফ্লাক্স বলি। ওষুধ যেই টার্গেট সাইট এ কাজ করত, সেটার স্ট্রাকচার বা গঠন বদলে দেয়া, যাতে সেখানে আর ওষুধ কাজ করতে না-পারে। আর অধিকাংশই আসলে ব্যাকটেরিয়ার নিজস্ব জেনেটিক মিউটেশন (পরিবর্তন) থেকেই হয়।
একটি দ্বীপের কথাই চিন্তা করুন। সেখানে আপনি একা। প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার জন্য আপনার হাতে খুব বেশি কিছু নেই, তবে অল্প কিছু সুযোগ আছে। আপনি সময়ের সাথে সাথে কিন্তু সেই পরিবেশে টিকে থাকার জন্য সবরকম চেষ্টাই করবেন। হয়তো বা টিকেও যাবেন। ব্যাকটেরিয়ার ব্যাপারটাও অনেকটা একই রকম। আমরা যখন প্রথমে কোনো ওষুধ দিই, তখন শুরুর দিকে ব্যাকটেরিয়া ঠিকই মারা যেতে শুরু করে বা তাদের গ্রোথ বা বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু যদি আমরা নির্দিষ্ট ডোজ নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত পূরণ না-করি, তবে সব প্যাথোজেনিক বা রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া আসলে মারা যায় না, বরং তারা ওই ওষুধের বিপরীতে টিকে থাকার জন্য কিছু সুযোগ পায় এবং অধিকাংশই মিউটেশনের মাধ্যমে রেজিস্ট্যান্স ডেভেলপ করে ফেলে।
সাধারণ মানুষ অনেকসময় না-বুঝেই ওষুধের ডোজ সম্পূর্ণ করেন না, কোর্স শেষ করেন না। এর পাশাপাশি অনেকে ফার্মেসি থেকে কোনো ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই অনেক সময় এন্টিবায়োটিক কিনে সেবন করতে শুরু করেন; অথচ সেই এন্টিবায়োটিক আদৌ ওই রোগের কারণে প্রয়োজন কি না বা তার সঠিক ডোজ কী হবে, এটা কিন্তু তাঁদের অজানা। ফলে ভুল এন্টিবায়োটিক বাছাই, এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার-অপব্যবহার দিনশেষে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরির এক বিশাল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভয়াবহতা
রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া তৈরির ফলে রোগের সংক্রমণ বাড়ে। আজকে যেই ইনফেকশনগুলো আমরা মামুলি মনে করছি, এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হলে সেগুলাই life threatening infection বা জীবন বিপন্নকারী হিসেবে আবির্ভূত হবে। যেমন, ইনফেকশন অনেক সময় কিডনি, মস্তিষ্ক বা মস্তিষ্কের আবরণ, হার্ট বা অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে, যেগুলোর চিকিৎসা দেয়া দুরুহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এমনকি ব্যবহার উপযোগী এন্টিবায়োটিক আর অবশিষ্ট থাকে না। অতিরিক্ত ওষুধ ব্যবহারে অনাকাঙ্ক্ষিত ও জটিল পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিকলাঙ্গতা ও রোগী মৃত্যুহার বাড়ে। এভাবে পরিবার, সমাজ সর্বস্তরে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। বরং বর্তমানে এটি একটি বৈশ্বিক উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একটি ভুল ধারণা
অনেকে মনে করেন, ‘ক’ এন্টিবায়োটিকের ডোজ পূর্ণ না-করলে ‘ক’-এর দেহে পরবর্তীকালে ওই ওষুধ আর কাজ করবে না, এটাই এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স। আসলে ব্যাপারটা এমন নয়। যেই ব্যাকটেরিয়া ইনফেকশনের জন্য দায়ী, সে-ই রেজিস্ট্যান্স ডেভেলপ করে, কোনো ব্যক্তি নয়। ওই ব্যাকটেরিয়া বা তার থেকে জন্ম নেয়া পরবর্তী জেনারেশনের সব ব্যাকটেরিয়াই রেজিস্ট্যান্স হবে ওই ড্রাগের প্রতি। ফলে এই ব্যাকটেরিয়া যখন অন্য কারও দেহে প্রবেশ করবে, সেই নতুন ব্যক্তিতেও আসলে ওষুধ কাজ করবে না।
করণীয়
প্রথমত এই ব্যাপারে সচেতন হওয়া জরুরি যে, ন্যূনতম এমবিবিএস ডাক্তার ছাড়া অন্য কারও কথা বা পরামর্শে (ফার্মেসিওয়ালা কিংবা ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেনটেটিভ কিংবা ডাক্তার নন এমন যে কেউ) এন্টিবায়োটিক সেবন থেকে বিরত থাকতে হবে। কোনো প্রয়োজনে সরাসরি ডাক্তারের পরামর্শে এন্টিবায়োটিক শুরু করতে হবে। দ্বিতীয়ত, এন্টিবায়োটিকের কোর্স শেষ করতে হবে নির্ধারিত ডোজেই এবং নির্দিষ্ট মেয়াদে। রোগের লক্ষণ বা উপসর্গ দূর হয়ে গেলে অনেকেই এন্টিবায়োটিক নেয়া বন্ধ করে দেন। এটা করা যাবে না। পাশাপাশি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ চিকিৎসকের অন্যান্য উপদেশও মেনে চলতে হবে। নিজে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি অন্যদেরও এ ব্যাপারে উৎসাহ দিতে হবে।