কসরের দূরত্ব : একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা 

উসতায শাইখুল ইসলাম 

কসর অর্থ কমানো। যেহেতু ভ্রমণলীন চার রাকাতবিশিষ্ট ফরয সালাতকে কমিয়ে দুই রাকাত আদায় করার নিয়ম রয়েছে, তাই এভাবে সালাত আদায় করাকে কসরুস সালাত বা সালাত কসর করা বলা হয়। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি অনুগ্রহ ও দান। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,  

وَإِذَا ضَرَبْتُمْ فِي الْأَرْضِ فَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَقْصُرُوا مِنَ الصَّلَاةِ إِنْ خِفْتُمْ أَنْ يَفْتِنَكُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا إِنَّ الْكَافِرِينَ كَانُوا لَكُمْ عَدُوًّا مُبِينًا 

‘তোমরা যখন পৃথিবীতে সফর করবে তখন যদি তোমাদের আশংকা হয়, কাফিররা তোমাদের জন্য ফিতনা সৃষ্টি করবে, তবে সালাত কসর করলে তোমাদের কোনো দোষ নেই। অবশ্যই কাফিররা তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। [সুরা আন-নিসা, ৪ : ১০১] 

আয়াতে কাফিরদের ফিতনা সৃষ্টির শর্ত দেয়ায় অনেকের খটকা লাগতে পারে যে, কাফিরদের ফিতনার ভয় না-থাকলে হয়তো কসর করতে হবে না। আসলে বিষয়টি এমন নয়। এ হাদিসটি বুঝলে খটকা দূর হয়ে যাবে—ইয়ালা ইবনু উমাইয়া বলেন, 

 قُلْتُ لِعُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ : لَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَقْصُرُوا مِنَ الصَّلَاةِ إِنْ خِفْتُمْ أَنْ يَفْتِنَكُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا  فَقَدْ أَمِنَ النَّاسُ، فَقَالَ : عَجِبْتُ مِمَّا عَجِبْتَ مِنْهُ، فَسَأَلْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ ذَلِكَ، فَقَالَ : صَدَقَةٌ تَصَدَّقَ اللَّهُ بِهَا عَلَيْكُمْ، فَاقْبَلُوا صَدَقَتَهُ 

‘আমি উমার ইবনুল খাত্তাবকে জিজ্ঞেস করলাম, “আল্লাহ যে বলেছেন—কাফিররা তোমাদেরকে কষ্ট দেবে এ আশংকা থাকলে সালাত কসর করে আদায় করতে তোমাদের কোন দোষ হবে না। কিন্তু এখন তো মানুষ নিরাপত্তা পেয়েছে।” এ কথা শুনে উমার বললেন—তুমি যে কারণে বিস্মিত হয়েছো আমিও ঠিক একই কারণে বিস্মিত হয়েছিলাম। তাই, এ বিষয়ে আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, “এটি তোমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সাদাকাহ (দান)। তাই তোমরা তাঁর দেয়া সাদাকাহ গ্রহণ করো।”’ [সহিহ মুসলিম, হাদিস নং : ৬৮৬] 

অতএব এটি স্থায়ী বিধানে পরিণত হয়ে গেছে। তবে সালাত কসর করা ফরয-ওয়াজিব নয়; বরং সুন্নাহ মুয়াক্কাদাহ। নুসুসের (কুরআন-সুন্নাহ) ভাষ্য থেকে এটি সুন্নাহই সাব্যস্ত হয়। কারণ কুরআনে ‘সালাত কসর করলে তোমাদের কোনো দোষ নেই’ বলা হয়েছে। এ ধরনের আরও কিছু আয়াত আছে—যেমন, ‘তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দিলে তোমাদের কোনো দোষ নেই’, ‘তোমরা স্বীয় রবের অনুগ্রহ তালাশ করাতে তোমাদের কোনো দোষ নেই’ ইত্যাদি আয়াতের মাধ্যমে আবশ্যক কোনো বিধান সাব্যস্ত হয় না। তাই একই নিয়মে কসরও আবশ্যক কোনো বিধান হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, হজের সময় সাফা-মারওয়া সায়ি করা-সংক্রান্ত আয়াতে ‘কোনো দোষ নেই’ শব্দ উল্লেখ রয়েছে। অথচ সাফা ও মারওয়ার সায়ি হজের একটি রুকন, আবশ্যক বিধান। এই প্রশ্নের জবাবে ইমাম নাওয়াবি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘“সহিহ বুখারি (হাদিস নং : ৪৮৬১)” ও “মুসলিম (হাদিস নং : ১২৭৭)”-এ আইশাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেছেন, “মদিনার আনসার ও গাসসান গোত্র ইসলাম-পূর্ব যুগে হজ করতে এসে সাফা ও মারওয়ায় মানাত মূর্তির তাহলিল করে সায়ি করত। তারা ইসলাম গ্রহণের পর উক্ত স্থানে সায়ি করায় কোনো সমস্যা আছে কি না জানতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিল। তখন তাদের এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আল্লাহ উক্ত আয়াত নাযিল করেন। তিনি জানিয়ে দিলেন যে—সাফা ও মারওয়ায় সায়ি করলে কোনো সমস্যা নেই।”’ [ইমাম আন-নাওয়াবি, আল-মাজমু, খণ্ড : 4, পৃষ্ঠা : ৩৪০]। তাই, এ আয়াতটি কসরের আয়াতের মতো নয়। প্রথমোক্ত হাদিস থেকেও এটি সুন্নাহ হওয়ার বিষয়টি বুঝে আসে। হাদিসে উল্লেখ আছে, ‘এটি তোমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সাদাকাহ (দান)। তাই তোমরা তাঁর দেয়া সদাকাহ গ্রহণ করো।’ ইবনু বাত্তাল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘এর দ্বারা বুঝে আসে যে, কসরটি মাশরু (বিধিবদ্ধ) হয়েছে বান্দার প্রতি সদয় ও তাদের সহজকরণের জন্য; বাধ্যতামূলককরণের অর্থে নয় এবং মুসাফিরকে বাধ্য করতেও নয়। আর এ বিষয়ে উম্মাহর ইজমা আছে যে, সাদাকাহগ্রহীতার জন্য সাদাকাহ গ্রহণ করা আবশ্যক নয়।’ [ইবনু বাত্তাল, শারহু সহিহিল বুখারি, খণ্ড : ২, পৃষ্ঠা : ১০]। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, মক্কার অদূরে মিনায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আবু বাকর, উমার ও উসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) সালাত কসর করেছেন। কিন্তু উসমানের খিলাফাতের শেষদিকে তিনি মিনায় কসর না-করে চার রাকাত চালু করেছিলেন। সকল সাহাবি এটা মেনেও নিয়েছিলেন। ইমাম নাওয়াবি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘কসর যদি ফরয বা ওয়াজিব হতো, তাহলে উসমান কসর বাদ দিয়ে পূর্ণ সালাত পড়তেন না এবং সকল সাহাবি এতে তাঁর আনুগত্যও করতেন না।’ [আল-মাজমু, প্রাগুক্ত]। আইশাহ রাদিয়াল্লাহু আনহার আমলও সহিহ সূত্রে প্রমাণিত আছে যে, তিনি সফরে চার রাকাত পড়তেন। যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, 

أَنَّ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا كَانَتْ تُصَلِّي فِي السَّفَرِ أَرْبَعًا، فَقُلْتُ لَهَا: لَوْ صَلَّيْتِ رَكْعَتَيْنِ؟ فَقَالَتْ: يَا ابْنَ أُخْتِي، إِنَّهُ لَا يَشُقُّ عَلَيَّ 

‘আইশাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহা) সফরে চার রাকাত সালাত পড়তেন। আমি তাঁকে বললাম, “যদি আপনি দুই রাকাত পড়তেন!” তিনি বললেন—ভাগ্নে, সফরটি আমার জন্য কষ্টকর নয়।’ [আস-সুনানুল কুবরা লিল-বাইহাকি, হাদিস নং : ৫৪৩০; হাদিসটি সহিহ] 

যদি এটি সুন্নাহ না-হয়ে ফরয বা ওয়াজিব হতো, তাহলে তিনি এমনটা কখনো করতেন না। সফর কষ্টকর হওয়া-না-হওয়ার সাথে কসর করা-না-করার কোনো আবশ্যকতা নেই। বিষয়টি ইচ্ছাধীন হওয়ায় তিনি এমনটা করেছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কাবিজয়ের পর ১৯ দিন মক্কায় অবস্থান করেছিলেন এবং পুরো সময়টা তিনি সালাত কসর করেছেন। এ সময় তাঁর সফরের কোনো কষ্ট ছিল না যে, সালাত কসর করতে হবে। আর প্রথমোক্ত নস-দুটোও কসরের জন্য কষ্টকে শর্ত দেয়নি। বরং উরওয়া ইবনুয যুবাইরের বর্ণনায় বুঝে আসে, আইশাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহা) এমনটা করেছেন যেন মানুষ একে জরুরি বিধান মনে না-করে সুন্নাহ ও ইচ্ছাধীন আমল মনে করে। ইমাম যুহরি (রাহিমাহুল্লাহ) আইশাহর কসর না-করার কারণ সম্পর্কে উরওয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। জবাবে তিনি বললেন,  

تَأَوَّلَتْ مَا تَأَوَّلَ عُثْمَانُ 

‘উসমান যে ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছেন, আইশাহও তা-ই গ্রহণ করেছেন।’ [সহিহ বুখারি, হাদিস নং : ১০৯০] 

উসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু) যে ব্যাখ্যায় মিনায় কসর করা বাদ দিয়েছিলেন সেটা হলো, তিনি ভয় পাচ্ছিলেন আরবের অজ্ঞ লোকেরা এই ধারণা করে বসতে পারে যে, চার রাকাতের সালাত হয়তো দুই রাকাতে পরিণত হয়ে গেছে। তাই তিনি তাদের এটা বোঝাতে চার রাকাত চালু করেছিলেন যে, সালাত দুই রাকাতে পরিণত হয়নি, বরং চার রাকাতও পড়া যায়। আবদুর রাহমান ইবনু আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহুর ছেলে হুমাইদ ইবনু আবদির রাহমান থেকে বর্ণিত,  

عَنْ عُثْمَانَ بْنِ عَفَّانَ أَنَّهُ أَتَمَّ الصَّلَاةَ بِمِنًى، ثُمَّ خَطَبَ النَّاسَ فَقَالَ: يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ السُّنَّةَ سُنَّةُ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَسُنَّةُ صَاحِبَيْهِ، وَلَكِنَّهُ حَدَثَ الْعَامَ مِنَ النَّاسِ، فَخِفْتُ أَنْ يَسَتَنُّوا 

‘উসমান ইবনু আফফান (রাদিয়াল্লাহু আনহু) মিনায় পূর্ণ সালাত আদায় করলন। তারপর বক্তব্যে লোকদের বললেন, “লোকসকল, সুন্নাহ হলো (কসরের ক্ষেত্রে) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর দুই সাহাবির (আবু বাকর ও উমার) সুন্নাহ। কিন্তু এ বছর (হজ) প্রচুর মানুষ হয়েছে। তাই আমি আশংকা করলাম তারা (দুই রাকাতকেই) নিয়ম হিসেবে গ্রহণ করে নিতে পারে।”’ [আস-সুনানুল কুবরা লিল-বাইহাকি, হাদিস নং : ৫৪৩৮; এর সনদ হাসান] 

এটি স্পষ্ট যে, হজে আগত লোকেরা মনে করতে পারে দুই রাকাত পড়াই নির্দিষ্ট পদ্ধতি। তাই তিনি চার রাকাত পড়ে এর বৈধতাও জানিয়ে দিলেন। তাই সফরে কসর ও পূর্ণ সালাত পড়া উভয়টিই বৈধ। আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকেও বর্ণিত আছে, ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আবু বাকর, উমার ও উসমানের খিলাফাতের প্রথম দিকে মিনায় দুই রাকাত পড়েছেন। তারপর উসমান চার রাকাত চালু করলেন। ইবনু উমার যখন ইমামের সাথে পড়তেন তখন চার রাকাতই পড়তেন, আর একাকী পড়লে দুই রাকাত আদায় করতেন।’ [সহিহ বুখারি, ১০৮২ ও মুসলিম, ৬৯৪]। আইশাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণিত আরেকটি হাদিস বোঝা দরকার। তিনি বলেছেন, 

الصَّلَاةُ أَوَّلُ مَا فُرِضَتْ رَكْعَتَيْنِ فَأُقِرَّتْ صَلَاةُ السَّفَرِ، وَأُتِمَّتْ صَلَاةُ الْحَضَرِ 

‘প্রথম অবস্থায় সালাত দুই রাকাত করে ফরয করা হয়। এরপর সফরে সালাত সেভাবেই স্থায়ী থাকে এবং মুকিম অবস্থায় সালাত পূর্ণ (চার রাকাত) করা হয়েছে।’ [সহিহ বুখারি, হাদিস নং : ১০৯০] 

এই হাদিসের ওপর ভিত্তি করে কসরকে ওয়াজিব বলা যায় না। যেহেতু তিনি বলেছেন ‘প্রথম অবস্থায় সালাত দুই রাকাত করে ফরয করা হয়। এরপর সফরে সালাত সেভাবেই স্থায়ী থাকে’, তাই কসরটি ওয়াজিব না-হয়ে ফরয হওয়ার কথা ছিল। অথচ ওয়াজিবের প্রবক্তারা একে ফরয বলেন না। মূলত এর অর্থ হলো, প্রথম অবস্থায় যে পরিমাণ রাকাত ফরয করা হয়েছিল, সফর অবস্থায় সেই পরিমাণটি বহাল রাখা হয়েছে; ফরযিয়াত উদ্দেশ্য নয়। ফরয থাকলে আইশাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহা) নিজেই এর বিপরীত আমল করতেন না। ইমাম ইবনু আবদিল বার (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,  

الذي ذهب إليه أكثرُ العلماء من السَّلف والخلف في قَصْر الصلاة في السفر أنَّه سُنَّةٌ مسنونة لا فريضة، وبعضُهم يقول: إنَّه رخصة وتوسعة 

‘সফরে সালাত কসর করাকে সালাফ-খালাফের অধিকাংশ আলিম সুন্নাহ হওয়ার ব্যাপারে মত দিয়েছেন; ফরয নয়। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, এটি রুখসাত (ছাড়) ও প্রশস্ততা।’ [আল-ইসতিযকার, খণ্ড : ২, পৃষ্ঠা : ২২৪] 

ইমাম ইবনু কুদামাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,  

أمَّا القصر فهو أفضلُ من الإتمام في قول جمهورِ العلماء، وقد كره جماعةٌ منهم الإتمام؛  

‘জুমহুর (অধিকাংশ) আলিমের মতে, ইতমাম (সালাত পূর্ণ করা) থেকে কসর উত্তম। আর আলিমদের একদল ইতমামকে মাকরুহ মনে করেছেন।’ [আল-মুগনি, খণ্ড : ২, পৃষ্ঠা : ১৯৯]  

ইমাম নাওয়াবি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,   

قد ذَكَرْنا أنَّ مذهبَنا أن القصر والإتمام جائزانِ، وأنَّ القصر أفضلُ من الإتمام، وبهذا قال عثمانُ بن عفَّان، وسعد بن أبي وقَّاص، وعائشةُ، وآخَرون، وحكاه العبدريُّ عن هؤلاءِ، وعن ابن مسعودٍ، وابن عُمرَ، وابن عبَّاس، والحسن البصري، ومالكٍ، وأحمدَ، وأبي ثورٍ، وداود، وهو مذهبُ أكثرِ العلماء 

‘আমাদের মাযহাব হলো, কসর ও ইতমাম উভয়টাই জায়িয। তবে ইতমাম থেকে কসর উত্তম। উসমান ইবনু আফফান, সাদ ইবনু আবি ওয়াক্কাস, আইশাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) ও অন্যান্যরা এমনটিই বলেছেন। এটি তাঁদের থেকে আবদারি বর্ণনা করেছেন এবং ইবনু মাসউদ, ইবনু উমার, ইবনু আব্বাস, হাসান আল-বাসরি, মালিক, আহমাদ, আবু সাওর, ও দাউদ থেকেও বর্ণনা করেছেন। এটাই অধিকাংশ আলিমের মাযহাব।’ [আল-মাজমু, খণ্ড : ৪, পৃষ্ঠা : ৩৩৭] 

উলামা কিরাম ব্যাপকভাবে মত দিয়েছেন, এমনকি এ ব্যাপারে তাদের ইজমাও আছে যে, মুসাফির যখন মুকিমের পেছনে ইকতিদা করবে, তখন তার জন্য ইতমাম (পূর্ণ সালাত আদায়) করা আবশ্যক। আর জুমা ও অন্যান্য সুন্নাহ সালাত মুসাফিরের জন্য আবশ্যক নয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজের সময় আরাফাহয় জুমা আদায় করেননি; বরং যুহর ও আসরকে একত্রে আদায় করেছেন। আর অন্যান্য সফরেও জুমা আদায় করেছেন বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না; বরং যুহর-আসর এবং মাগরিব-ইশাকে একত্র করে আদায় করেছেন মর্মে অনেক সহিহ হাদিস বর্ণিত রয়েছে। আর সফরে সুন্নাহ সালাতও তিনি সবসময় আদায় করেননি। কখনো কখনো ফজরের দুই রাকাত সুন্নাহ, কখনো বিতর, কখনো সালাতুদ দুহা আদায় করেছেন মর্মে হাদিসে বর্ণিত রয়েছে। তবে এগুলো মুসাফিরের জন্য ইচ্ছাধীন; আদায় করলে সাওয়াব পাবে। মুসাফির যদি কোনো মুকিমের পেছনে সালাত আদায় করে, তাহলে কসর না-করে পূর্ণ সালাতই আদায় করবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘ইমাম নির্ধারণ করা হয় তাঁর ইকতিদা করার জন্য।’ [সহিহ বুখারি, হাদিস নং : ৩৭৮]। তাই ইমামের পেছনে পূর্ণ চার রাকাতই আদায় করা আবশ্যক।  

মুসাফির কতদিন অবস্থানের নিয়ত করলে কসর করতে হয় না, এ ব্যাপারে একাধিক মত রয়েছে—১৯ দিন, ১৫ দিন, ৪ দিন, ৪ দিনের অধিক এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ ছাড়া যখনই কোথাও সাধারণ অবস্থানের নিয়ত করবে, তখনই কসর করা ছেড়ে দেবে। এই পাঁচটি মত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিষয়টি যেহেতু মতভেদপূর্ণ এবং বিস্তারিত আলোচনারও দাবি রাখে, তাই এই বিষয়ে এখানে আর আলোচনা করা হচ্ছে না। 

কতটুকু দূরত্বের সফর করলে সালাত কসর করতে হবে এ ব্যাপারে উলামা কিরামের মাঝে বেশ মতানৈক্য রয়েছে। দুটো মত প্রসিদ্ধ হওয়ায় এগুলোকে সামনে আনা যায়—একটি হলো ৪৮ মাইলের দূরত্বে বের হলেই সালাত কসর করা, আরেকটি হলো কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণের দূরত্ব নয়; বরং উরফ বা প্রচলনের ভিত্তিতে যে পরিমাণ দূরত্বকে সফর বলে মনে করা হয়, সে পরিমাণ সফরের নিয়তে নিজ এলাকা ছেড়ে গেলেই সালাত কসর করা। সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস ও আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে ৪৮ মাইলের দূরত্ব প্রমাণিত। ইমাম বুখারি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, 

كَانَ ابْنُ عُمَرَ، وَابْنُ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ يَقْصُرَانِ وَيُفْطِرَانِ فِي أَرْبَعَةِ بُرُدٍ، وَهِيَ سِتَّةَ عَشَرَ فَرْسَخًا 

‘ইবনু উমার ও ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা চার বুরুদ দূরত্বে কসর করতেন এবং সাওম পালন করতেন না। চার বুরুদের পরিমাণ হচ্ছে ষোলো ফারসাখ।’ [সহিহ বুখারি, অধ্যায় : সলাত কসর করা] 

উল্লেখ্য বুরুদ শব্দটি ‘বারিদ’-এর বহুবচন। শব্দটি একসময় ফারসি ভাষায় ‘বাহক’ অর্থে ব্যবহৃত হতো। পরে আরবরা নির্দিষ্ট দূরত্ব বোঝাতে ব্যবহার শুরু করে। এক বারিদ সমান চার ফারসাখ হয়, আর এক ফারসাখ তিন মাইলের সমান। তাহলে এক বারিদ হলো বারো মাইল; আর চার বারিদ ৪৮ মাইল। ইমাম বুখারি আসারটির সনদ উল্লেখ না-করলেও এটি সনদসহ বর্ণনা করেছেন ইমাম বাইহাকি (আস-সুনানুল কুবরা, হাদিস নং : ৫৩৯৭) ও ইমাম ইবনুল মুনযির (আল-আওসাত, হাদিস নং : ২২৬১)। ইমাম আলবানি একে সহিহ বলেছেন (ইরওয়াউল গালিল : ৫৬৫)। আতা (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণিত হয়েছে,  

سُئِلَ ابن عباس : أَنَقْصُرُ  إلَى عَرَفَةَ؟ فَقَالَ : لَا وَلَكِنْ إلَى عُسْفَانَ وَإِلَى جُدَّةَ وَإِلَى الطَّائِفِ 

‘ইবনু আব্বাসকে জিজ্ঞেস করা হলো, “আমরা কি আরাফায় গিয়ে কসর করব (মক্কা থেকে)?” তিনি বললেন—না, উসফান, জুদ্দাহ এবং তায়িফ-এ গেলে কসর করবে।’ (ইমাম আশ-শাফিয়ি, আল-উম্ম, খণ্ড : 1, পৃষ্ঠা : 211; মুসান্নাফু আবদির রাযযাক, হাদিস নং : ৪২৯৬)। হাফিয ইবনু হাজার আসকালানি বর্ণনাটিকে সহিহ বলেছেন। [আত-তালখিসুল হাবির, খণ্ড : ২, পৃষ্ঠা : ১১৭]। 

ইমাম মালিক বলেছেন, মক্কা থেকে উসফান, জুদ্দাহ ও তায়িফের দূরত্ব চার বুরুদ (৪৮ মাইল) [আল-মুয়াত্তা, হাদিস নং : ৩৯৮]। আবদুল্লাহ ইবনু উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর ছেলে সালিম বলেন, 

إنَّ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عُمَرَ رَكِبَ إِلَى ذَاتِ النُّصُبِ، فَقَصَرَ الصَّلَاةَ فِي مَسِيرِهِ ذَلِكَ 

‘আবদুল্লাহ ইবনু উমার বাহনে আরোহণ করে যাতুন নুসুব নামক স্থানের দিকে যাত্রা করলেন। তিনি এই পরিমাণ যাত্রাতেই সালাতকে কসর করলেন।’ [মুয়াত্তা মালিক, হাদিস নং : ৩৯৪; এর সনদ সহিহ]। আসারটি বর্ণনা করে ইমাম মালিক বলেন—মদিনা ও যাতুন নুসুবের মধ্যবর্তী দূরত্ব হল চার বুরুদ (৪৮ মাইল)। ইমাম মালিক নাফি থেকে বর্ণনা করেছেন, 

إنَّهُ كَانَ يُسَافِرُ مَعَ ابْنِ عُمَرَ الْبَرِيدَ، فَلَا يَقْصُرُ الصَّلَاةَ 

‘তিনি ইবনু উমারের সাথে এক বারিদ (১২ মাইল) সফর করেছিলেন। কিন্তু তিনি সালাতকে কসর করেননি।’ [আল-মুয়াত্তা, হাদিস নং : 397] 

এসব আসার সামনে রেখে একদল আলিম বলেন, কমপক্ষে ৪৮ মাইল সফরের নিয়তে নিজ এলাকা থেকে বের হলে সালাতকে কসর করতে পারবে এবং সাওম না-রাখা বৈধ হবে। আলিমদের আরেক জামাআত বলেন, নির্দিষ্ট পরিমাণের দূরত্ব নয়; বরং উরফ বা প্রচলন হিসেবে সেটা নির্ধারিত হবে। কারণ কুরআনে কসরের আলোচনা এসেছে, কিন্তু কোথাও কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ দূরত্বের কথা বলা হয়নি এবং কোনো হাদিসেও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সফরের দূরত্বের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেননি। তাই দেখা যায়, কসরের ব্যাপারে সাহাবিদের থেকে বাহ্যত পরস্পরবিরোধী এবং একই সাহাবি থেকে ভিন্ন ভিন্ন আসারও পাওয়া যায়। কারণ, তাঁরাও বিষয়টিকে উরফ হিসেবেই নিয়েছেন। তাই যার কাছে যখন যে পরিমাণ দূরত্ব সফর হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, সেটিতেই তাঁরা কসর করেছেন। ইবনু উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন, 

إني لأسافر الساعة  من النهار فأقصر 

‘আমি দিনের কিয়দংশ সফর করেও কসর করি’। [আল-মুসান্নাফ লি-ইবনি আবি শাইবাহ, হাদিস নং : ৮৩৫৭; এটি সহিহ সনদে বর্ণিত; শাইখ আলবানি, ইরওয়াউল গালিল, খণ্ড : 3, পৃষ্ঠা : ১৯] 

তিনি আরও বলেছেন, 

لَوْ خَرَجْتُ مِيلًا  قَصَرْت الصَّلَاةَ 

‘আমি যদি এক মাইল সফর করি, তাও সালাত কসর করি।’ [ইবনু হাযম, আল-মুহাল্লা বিল-আসার, খণ্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ১৯৯; এর সনদকে ইবনু হাজার আসকালানি সহিহ বলেছেন, ফাতহুল বারি, খণ্ড : 2, পৃষ্ঠা : ৫৬৭] 

ইবনু উমার থকে আরও বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, 

تقصر الصلاة في مسيرة ثلاثة أميال 

‘তিন মাইলের সফরে সালাত কসর করতে হয়।’ [মুসান্নাফু ইবনি আবি শাইবাহ, হাদিস নং : ৮৩৩৭] 

 নাফি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, 

إن ابن عمر كان يقيم بمكة  فإذا خرج إلى منى قصر 

‘ইবনু উমার মক্কায় অবস্থান করতেন। যখন মিনায় যেতেন, কসর করতেন।’ [পাগুক্ত : ৮৪০২]  

উভয় বর্ণনাই সহিহ [ইরওয়াউল গালিল, খণ্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ১৮-১৯]। উল্লেখ্য, মক্কা থেকে মিনার দূরত্ব চার মাইল। লাজলাজ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, 

كنا نسافر  مع عمر بن الخطاب فنسير ثلاثة أميال فيتجوز في الصلاة ويقصر 

‘আমরা উমার ইবনুল খাত্তাবের সাথে তিন মাইল সফর করতাম। তখন তিনি সালাতে কসর করাকে জায়িয মনে করতেন।’ [মুসান্নাফু ইবনি আবি শাইবাহ : ৮৩৫৫; এর সনদ হাসান] 

 আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর ব্যাপারে বর্ণিত আছে, 

أنه خرج مسيرة أربعة فراسخ , فصلى الظهر ركعتين والعصر ركعتين 

‘তিনি চার ফারসাখ (১২ মাইল) দূরত্বের সফরে বের হয়ে যুহর ও আসরের সালাতকে দুই রাকাত করে আদায় করেছেন।’ [আল-মুহাল্লা লি-ইবনি হাযাম, খণ্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ২০০]। এর সনদের সকল বর্ণনাকারীই সিকাহ। 

সায়িদ ইবনুল মুসাইয়িবকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘রিম নামক স্থানে গিয়ে কি সালাতকে কসর ও সাওম ভাঙতে পারব?’ তিনি বলেছিলেন—হাঁ পারবে, এটি মদিনা থেকে এক বারিদ (১২ মাইল) দূরত্বে।’ [আল-মুসান্নাফ লি-ইবনি আবি শাইবাহ : ৯২৬২)]। ইমাম ইবনু হাযম বলেছেন—এর সনদ সূর্যের মতো। [আল-মুহাল্লা : খণ্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ২০০]। ইমাম আবদুর রাযযাক আবদুল্লাহ ইবনু উমারের একটি আসার বর্ণনা করেছেন। এতে রয়েছে—তিনি রিম পর্যন্ত সফর করে সালাত কসর করেছেন। তারপর আবদুর রাযযাক বলেছেন—রিম হল মাদিনা থেকে ত্রিশ মাইল দূরে। [আল-মুসান্নাফ : ৪৩০১]। এটি তিনি ইমাম মালিকের সনদে বর্ণনা করেছেন। আসারটি ‘আল-মুয়াত্তায়’ও বর্ণিত হয়েছে। এটি বর্ণনা করে ইমাম মালিক বলেছিলেন—রিম মদিনা থেকে চার বুরুদ বা ৪৮ মাইল দূরে।’ বোঝা গেল রিমের দূরত্বের ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। কিন্তু ইবনু উমারের অন্যান্য আসার থেকে প্রমাণিত, তিনি নির্দিষ্ট কোনো দূরত্বকে গ্রহণ করেননি। তাই বলা যায়, ইবনু আব্বাস যে নির্দিষ্ট দূরত্ব নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সেটা উরফ বা প্রচলনের ভিত্তিতেই তিনি বলেছেন। কারণ, নস (কুরআন ও হাদিস) এই বিষয়ে কোনো পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়নি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমল থেকেও এটিই বুঝে আসে যে, উরফ হিসেবে যতটুকু দূরত্বের ভ্রমণকে সফর বলে মনে করেছেন, ততটুকুতেই সালাত কসর করেছেন। ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াযিদ আল-হুনায়ি বলেন, 

سَأَلْتُ أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ عَنْ قَصْرِ الصَّلَاةِ ؟ فَقَالَ أَنَسٌ : كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا خَرَجَ مَسِيرَةَ ثَلَاثَةِ أَمْيَالٍ – أَوْ ثَلَاثَةِ فَرَاسِخَ . شَكَّ شُعْبَةُ – يُصَلِّي رَكْعَتَيْنِ 

‘আমি আনাস ইবনু মালিককে সফররত অবস্থায় সালাতে কসর করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন—রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তিন মাইল অথবা তিন ফারসাখ (নয় মাইল) দূরত্বের সফরে বের হতেন, তখনই দুই রাকাত সালাত আদায় করতেন। ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াযিদ আল-হুনায়ি তিন মাইল দূরত্বের কথা বলেছেন না কি তিন ফারসাখ তাতে বর্ণনাকারী শুবার সন্দেহ রয়েছে।’ [সহিহ মুসলিম, হাদিস নং : 1201] 

হজের সময় মিনা, আরাফাহ ইত্যাদি স্থানেও রাসুল আল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সালাত কসর করেছেন। মক্কার লোকেরাও তাঁর সাথে ছিল। তারা তাঁর পেছনেই সালাত আদায় করেছে। অথচ তাঁদের কসর করতে হবে না বলে কোনো নির্দেশনা তিনি দেননি। মদিনা থেকে মিনার দূরত্ব মাত্র চার মাইল। আবু বাকর, উমার ও উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুমের খিলাফাতের প্রথম দিকেও এ নিয়মই বহাল ছিল। উসমানের যুগের শেষদিকে তিনি মিনায় সালাত কসর না-করে চার রাকাত পড়ার নিয়ম করে ফেললেন। তিনি উরফের ভিত্তিতেই কাজটি করেছিলেন। অন্যান্য সাহাবিরা তা মেনেও নিয়েছিলেন। আবদুর রহমান ইবনু ইয়াযিদ থেকে বর্ণিত, 

صَلَّى عُثْمَانُ بِمِنًى أَرْبَعًا، فَقَالَ عَبْدُ اللَّهِ : صَلَّيْتُ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَكْعَتَيْنِ، وَمَعَ أَبِي بَكْرٍ رَكْعَتَيْنِ، وَمَعَ عُمَرَ رَكْعَتَيْنِ. زَادَ عَنْ حَفْصٍ : وَمَعَ عُثْمَانَ صَدْرًا مِنْ إِمَارَتِهِ، ثُمَّ أَتَمَّهَا. زَادَ مِنْ هَاهُنَا عَنْ أَبِي مُعَاوِيَةَ : ثُمَّ تَفَرَّقَتْ بِكُمُ الطُّرُقُ ، فَلَوَدِدْتُ أَنَّ لِي مِنْ أَرْبَعِ رَكَعَاتٍ رَكْعَتَيْنِ مُتَقَبَّلَتَيْنِ. قَالَ الْأَعْمَشُ : فَحَدَّثَنِي مُعَاوِيَةُ بْنُ قُرَّةَ عَنْ أَشْيَاخِهِ ، أَنَّ عَبْدَ اللَّهِ صَلَّى أَرْبَعًا. قَالَ : فَقِيلَ لَهُ : عِبْتَ عَلَى عُثْمَانَ ثُمَّ صَلَّيْتَ أَرْبَعًا ؟ قَالَ : الْخِلَافُ شَرٌّ 

‘উসমান মিনায় চার রাকাত সালাত আদায় করেছেন (কসর করেননি)। আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ বলেন, “আমি নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আবু বাকর ও উমারের সাথে দুই রাকাত সালাত আদায় করেছি। উসমানের খিলাফাতের শুরুতে তাঁর সাথেও দুই রাকাত সালাত আদায় করেছি (এটি হাফস ইবনু গিয়াসের বর্ণনায় রয়েছে)। এরপর উসমান পূর্ণ চার রাকাত পড়লেন।’  

আবু মুয়াবিয়াহ থেকে বর্ণনাকারী অতিরিক্ত বর্ণনা করেন যে, পরে এ নিয়ে মতভেদ দেখা দেয়। আমি নিজের জন্য চার রাকাতের চেয়ে দুই রাকাত মকবুল সালাতই পছন্দ করি। আমাশ বলেন, ‘মুয়াবিয়াহ ইবনু কুররাহ তাঁর শাইখদের সূত্রে আমাকে বলেছেন, “পরে আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ উসমানের সাথে চার রাকাতই পড়েছেন। কেউ তাঁকে জিজ্ঞেস করল, উসমান চার রাকাত সালাত আদায়ের কারণে আপনি তাঁর সমালোচনা করেছেন। অথচ দেখছি আপনিও চার রাকাতই আদায় করেছেন। তখন তিনি বললেন—মতপার্থক্য করা তো বাজে কাজ।”’ [সুনানু আবি দাউদ, হাদিস নং : ১৯৬০]। হাদিসটি ‘সহিহ বুখারি (১০৮২, ১৬৫০)’ ও ‘সহিহ মুসলিম (৬৯৪)’-এও বর্ণিত হয়েছে। 

এসব হাদিস ও আসারকে সামনে রাখলে কসরের জন্য দূরত্ব নির্দিষ্ট করা যায় না। তাই, উলামা কিরামের বড় এক জামাআত এই মতের ওপরই রায় দিয়ে গেছেন। তবে কসরের ক্ষেত্রে সফরের ধরনটাও বিবেচনায় রাখতে হবে। মিনায় উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর কসর না-করার কারণ হিসেবে এটাও বলা হয়েছে যে, তখন মিনা এলাকায় লোক বসতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাই মুসাফিরদের সফর, থাকা, পাথেয় বহন ইত্যাদি ক্ষেত্রে অসুবিধা প্রায় দূর হয়ে যাচ্ছিল। তবে যেহেতু সফর বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে—পায়ে হেঁটে, গাড়িতে, বিমানে—তাই, এ ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে সবাইকে উরফের ওপর ছেড়ে দিলে অনেকেরই ভুল হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে একটা সমাধান এমন হতে পারে যে, কেউ উরফে সফর নির্ধারণ করতে না-পারলে বা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়লে ইবনু আব্বাসের বলে দেয়া দূরত্বকে ধরে নিয়ে ৪৮ মাইলের ওপর আমল করবে। এ ছাড়াও কেউ চাইলে সাবধানতাবশত ৪৮ মাইলকেই নির্দিষ্ট করে কসরের আমল করতে পারে।