উসতায শাইখুল ইসলাম
তারাবির রাকাতসংখ্যা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দিষ্ট করে দিয়ে যাননি। আর তা রমাদানের বিশেষ কোনো ইবাদতও নয়; বরং সারা বছরেরই আমল, যাকে কিয়ামুল লাইল, সালাতুল লাইল (রাতের সালাত) বলা হতো। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মিম্বারে উপবিষ্টাবস্থায় এক লোক সালাতুল লাইল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিল। তিনি বললেন—তা দুই রাকাত দুই রাকাত করে; যখন ভোর হওয়ার আশঙ্কা করবে, তখন এক রাকাত আদায় করে নিও। [সহিহ বুখারি : ৪৭২]
স্পষ্ট যে, সালাতুল লাইলের রাকাতসংখ্যা নির্দিষ্ট নয়। তবে রমাদানে সব আমালেরই ফযিলত বেড়ে যাওয়ায় সালাতুল লাইলের গুরুত্বও বেড়ে যায়। এ জন্যই তিনি বলেছেন—যে লোক রমাদানের রাতে ইমানসহ সাওয়াবের আশায় সালাতে দাঁড়িয়ে যায়, তার অতীতের পাপ ক্ষমা করে দেয়া হয়। [সহিহ বুখারি : ৩৭]
আর তাই একে রমাদানে কিয়ামু রমাদানও বলা হয়। রমাদানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সালাত কেমন ছিল মর্মে প্রশ্নের জবাবে আইশাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেন,
مَا كَانَ يَزِيدُ فِي رَمَضَانَ، وَلاَ فِي غَيْرِهَا عَلَى إِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً
‘রমাদান ও রমাদান ছাড়া অন্য সময়ে তিনি এগারো রাকাতের বেশি পড়তেন না।’ [সহিহ বুখারি, কিতাবু সালাতিত তারাবি, হাদিস নং : ২০১৩]
লক্ষণীয় যে, আবু সালামাহ আইশাহ রাদিয়াল্লাহু আনহার কাছে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রমাদানের সালাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। আইশাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহা) জবাবে রমাদান ও রমাদানের বাইরের সালাতকে একত্রে উল্লেখ করেছেন। এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমাদানসহ সারা বছরই এগারো রাকাতের বেশি পড়তেন না। তিন রাকাত বিতরসহ এগারো রাকাত। যেহেতু তাঁর রমাদানের সালাত সম্পর্কেই জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তাই তিনি যদি রমাদানে এ ছাড়া অন্য কোনো সালাত আদায় করতেন বা তারাবি ও তাহাজ্জুদ নামে ভিন্ন ভিন্ন সালাত আদায় করতেন, অবশ্যই আইশাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহা) তা উল্লেখ করতেন। প্রশ্ন করা হয়েছে রমাদানের সালাত নিয়ে। উত্তরদাতা ভিন্ন জবাব দেবেন কেন? আইশাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহা) এভাবে জবাব দিয়ে সুস্পষ্টভাবে এটিই বুঝিয়েছেন যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সারা বছর তাহাজ্জুদ নামে যা আদায় করা করতেন, রমাদানেও এটিই আদায় করতেন। আর সবারই জানা যে, তাঁর উক্ত সালাতটি ছিল দীর্ঘ কিয়ামবিশিষ্ট এবং তা সারারাত আদায় করতেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদিও নিজে এভাবেই আমল করেছেন, তবে উম্মাহর জন্য তিনি কোনো নির্দিষ্ট রাকাতসংখ্যা বলে যাননি; বরং দুই রাকাত দুই রাকাত বলে ব্যাপক করে দিয়েছেন। এর পেছনে অবশ্যই হিকমাহ রয়েছে, যা পরবর্তী আলোচনায় বুঝতে পারব, ইনশাআল্লাহ। রমাদানে তিনি এই সালাতটি জামাআতেও আদায় করেছেন। তবে উম্মাহর জন্য ফরয হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তিনদিনের বেশি জামাআত কায়িম করেননি। [সহিহ বুখারি : ১১২৯, সহিহ মুসলিম : ৭৬১]
পরবর্তীকালে আর কেউ নিজেরা জামাআত কায়িমের চেষ্টা করেননি। তারপর উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর যুগে মদিনার মসজিদে তিনিই জামাআতের পুনঃসূচনা করেন। [মুয়াত্তা মালিক : ৩০১;সহিহ বুখারি : 2010]
তখন তিনি রাকাতসংখ্যা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। সাহাবি উবাই ইবনু কাব ও তামিম আদ-দারিকে ইমাম নিযুক্ত করে এগারো রাকাত পড়াতে নির্দেশ দেন। [মুয়াত্তা মালিক, কিতাবুস সালাত : 302; এর সানাদ সহিহ]
সুলাইমান ইবনু খালফ আল-বাজি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন :
ولعل عمر إنما امتثل في ذلك صلاة النبي صلى الله عليه وسلم من الليل على ما روته عائشة أنه كان يصلي من الليل إحدى عشرة ركعة
‘উমার এই ক্ষেত্রে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সালাতুল লাইলের অনুসরণ করেছেন, যেটি আইশাহ বর্ণনা করেছেন যে, তিনি রাতে এগারো রাকাত সালাত আদায় করতেন।’ [আল-মুনতাকা শারহুল মুয়াত্তা : ৩০২ নং হাদিসের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য]
তবে এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, উমার ইবনুল খাত্তাব বিশ রাকাত পড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু বর্ণনাটা দয়িফ। এর বিবরণ হলো—উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) কর্তৃক রমাদানে সালাতুল লাইলের জামাআত পুনঃসূচনার ঘটনাটির বর্ণনাকারী হলেন সাহাবি আস-সায়িব ইবনু ইয়াযিদ; তার থেকে বর্ণনা করেছেন মুহাম্মাদ ইবনু ইউসুফ। আর তার থেকে বর্ণনাকারীগণ হলেন—ইমাম মালিক, ইসমাইল ইবনু জাফার, ইয়াহইয়া ইবনু সায়িদ, ইসমাইল ইবনু উমাইয়াহ, উসামাহ ইবনু যাইদ, আবদুল আযিয ইবনু মুহাম্মাদ ও দাউদ ইবনু কাইস। সবাই সিকাহ (নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী)। এঁদের মাঝে একমাত্র দাউদ ছাড়া সবাই এগারো রাকাতের কথা বর্ণনা করেছেন। কিন্তু দাউদ বলেছেন বিশ রাকাতের কথা। [মুয়াত্তা মালিক, ৩০২; আল-জুয লি-ইসমাইল ইবনি জাফার, ৪৪০; আখবারুল মাদিনাহ লি-ইবনি শাইবাহ, ২/২৭৮; ফাওয়াইদুন নাইসাবুরি, ১৬, ১৭; সুনানু সায়িদ ইবনি মানসুর, মুসান্নাফু আবদির রাযযাক, ৭৭৩০]
হাদিসশাস্ত্রের উসুল হলো—কোনো একজন সিকাহ যদি একাধিক সিকাহ ব্যক্তির বিপরীত বর্ণনা করে, তাহলে তার বর্ণনাটা ‘শায’ হিসেবে অভিহিত হয়ে দয়িফ হয়ে যায় এবং অন্যদের বর্ণনাটি ‘মাহফুয’ নামে বিবেচিত হয়ে সহিহ হিসেবে সাব্যস্ত থাকে। তাই উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর এগারো রাকাতের নির্দেশনাটিই সহিহ এবং বিশ রাকাতের নির্দেশনা-সংবলিত বর্ণনাটা দয়িফ। যারা বলেন, এই বর্ণনায় ইমাম মালিকের ‘ওয়াহাম’ (ভ্রম) হয়েছে, তাঁদের কথা সঠিক নয়। কারণ আরও পাঁচজন বর্ণনাকারী ইমাম মালিকের অনুরূপ বর্ণনা করেছেন, যা উল্লেখ করা হয়েছে।
তখন তাঁরা রাতভর (ফজরের আগপর্যন্ত) সালাতে দাঁড়িয়ে থাকতেন এবং ইমামগণ প্রতি রাকাতে দুইশোর মতো আয়াত তিলাওয়াত করতেন। এই দীর্ঘ কিয়ামের ফলে মুসল্লিদের কষ্ট হতো। তাই তাঁরা লাঠিতে ভর দিয়ে সালাত আদায় করতেন বলে বর্ণিত হয়েছে (প্রাগুক্ত)। এ জন্যই তো পরে তাঁরা রাকাতসংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। যেন অধিক রুকু-সাজদাহ দ্বারা দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকার কষ্ট না হয়। উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) যদিও শুরুতে বিশ রাকাতের নির্দেশ করেন নি, করেছেন এগারো রাকাতেরই, তবে কিছু বর্ণনায় দেখা যায় তাঁর যুগেই বিশ রাকাত পড়া হতো। এর মাঝে আস-সায়িব ইবনু ইয়াযিদ থেকে ইয়াযিদ ইবনু খুসাইফাহর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, উমারের যুগে বিশ রাকাত পড়া হতো। [আস-সিয়াম লিল-ফিরইয়াবি, পৃষ্ঠা : ১৩১, হাদিস নং : ১৭৬]
ইয়াযিদ ইবনু খুসাইফাহকে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) মুনকারুল হাদিস বললেও অন্যত্র তাঁকে সিকাহ বলেছেন এবং অন্যান্য ইমাম থেকেও তাঁর ব্যাপারে তাউসিক (সমর্থন/কাউকে সিকাহ বলা) রয়েছে। তাই তাঁর বর্ণনাটি সহিহ। এ ছাড়া বিশ রাকাতের আরও কিছু বর্ণনা রয়েছে, যেগুলোতে কমবেশি দুর্বলতা বিদ্যমান। ইমাম বাইহাকি ‘আস-সুনানুল কুবরাহ’তে (হাদিস নং : ৪৬১৭) এটিই ইয়াযিদ ইবনু খুসাইফাহ থেকে আলি ইবনুল জাদের সূত্রে বর্ণনা করেছেন। এর সনদ ও মতন দুটোতেই সমস্যা রয়েছে। তিনি ‘আস-সুনানুস সগির’-এ (হাদিস নং : ৮২১) ইয়াযিদ ইবনু খুসাইফাহ থেকেই ভিন্ন আরেকটি সনদে এটি বর্ণনা করেছেন। সনদটি হাসান। এ বিষয়ে আরও কিছু বর্ণনা আছে, যা মুরসাল সূত্রে বর্ণিত। যারা ইরসাল করে বর্ণনা করেছেন তাঁরা হলেন—ইয়াহইয়া ইবনু সায়িদ, আবদুল আযিয ইবনু রুফাই ও ইয়াযিদ ইবনু রুমান। [মুয়াত্তা মালিক: ৩০৩; মুসান্নাফু ইবনি আবি শাইবাহ : 7682, 7684]
সবাইই সিকাহ (বিশ্বস্ত)। অথচ তাঁদের কেউই উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর যুগ পাননি। তাঁদের বর্ণনাগুলো মুরসাল। সনদে ইনকিতা (বিচ্ছিন্নতা) রয়েছে। সাধারণত মুরসাল বর্ণনা দয়িফের একটা প্রকার। জুমহুর মুহাদ্দিদের মতে মুরসাল গ্রহণযোগ্য ও প্রামাণ্য নয়। উল্লেখ্য, ইরসাল বলা হয় কোনো তাবিয়ি তাঁর ওপরের বর্ণনাকারীকে বাদ দিয়ে সরাসরি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করা। তার বর্ণিত হাদিসকে মুরসাল বলা হয়। এটিই মুরসালের প্রসিদ্ধ সংজ্ঞা। জুমহুর মুহাদ্দিস এবং অধিকাংশ উসুলবিদ একে বর্জন করেছেন। কারণ হলো এর অস্পষ্টতা। সনদ থেকে বাদপড়া ব্যক্তিটির অবস্থা অজ্ঞাত। তিনি সাহাবিও হরে পারেন, না-ও হতে পারেন; বাদপড়া ব্যক্তি একজনও হতে পারে, একাধিকও হতে পারে। যিনি ইরসাল করেন তাকে মুরসিল বলা হয়। হতে পারে মুরসিল ব্যক্তি সাহাবি ছাড়া অন্য কোনো অজ্ঞাত লোকের কাছ থেকে বর্ণনা করেছে, কিংবা কোন দয়িফ বর্ণনাকারীর কাছে থেকে বর্ণনা করেছে। এতসব সম্ভাবনার ওপর কোনো হাদিসকে সহিহ বলা যায় না। সহিহ হওয়ার জন্য ইয়াকিন বা দৃঢ়ভাবে জানাশোনা থাকা আবশ্যক। তাই এটা প্রামাণ্য ও গ্রহণযোগ্য নয়। ইমাম ইবনু আবি হাতিম বলেছেন—এমন যদি হয় যে, মুরসিল ব্যক্তি সিকাহ (বিশ্বস্ত) ব্যতীত অন্য কারও কাছ থেকে বর্ণনা করে না, তবুও এতসব ইবহাম বা অস্পষ্টতার কারণে তা তাউসিক হিসেবে বিবেচিত হবে না। [আল-মারাসিল, পৃষ্ঠা : ১০৪]
তবে কোনো কোনো আলিম মুরসালকে নির্দ্বিধায় গ্রহণ করেছেন। এ ক্ষেত্রে ইমাম শাফিয়ি কিছু শর্তসাপেক্ষে মুরসাল হাদিস গ্রহণ করার পক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন। তিনি ‘আর-রিসালাহ’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা : ৪৬১-৪৬৭, তাহকিক : আহমাদ শাকির) সেগুলো উল্লেখ করেছেন। তাঁর শর্তগুলো হলো, মুরসালটি অন্য সূত্রে মুত্তাসিল (ধারাবাহিক বা অবিচ্ছিন্ন) সনদে বর্ণিত হতে হবে, অথবা এর ভাষ্য আরেক মুরসাল সনদে অন্য আরেকজন বর্ণনাকারী থেকে বর্ণিত থাকতে হবে, যা প্রথম মুরসিলের উসতায থেকে বর্ণিত নয়; কিংবা এর স্বপক্ষে কোনো সাহাবির বক্তব্য বর্ণিত থাকতে হবে। আর মুরসিল ব্যক্তি কার কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন, তা যদি প্রকাশ করেন, সেটা যেন কোনো অজ্ঞাত ব্যক্তি না হয়।
যেহেতু বিষয়টি সহিহ ও দয়িফের সম্ভাব্যতার ওপর আবর্তিত, তাই মুরসিল ব্যক্তির হালাত দেখতে হবে। তিনি যদি সিকাহ (বিশ্বস্ত) হন, ইরসালকৃত বর্ণনাটির ব্যাপারে জ্ঞাত ও সতর্ক থাকেন এবং তাঁর সমস্ত বর্ণনা পর্যবেক্ষণ করার পর দেখা যায় যে, তিনি সিকাহ (বিশ্বস্ত) ব্যতীত অন্য কারও কাছ থেকে কখনো কোনোকিছু বর্ণনা করেন না, পাশাপাশি তার অনুরূপ কোনো মুরসাল বর্ণনা অন্য সূত্রে বিদ্যমান থাকে ও সহিহ হয়, এমন অবস্থায় সেটি গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। পক্ষান্তরে মুরসিল যদি সিকাহ-দয়িফ সবার কাছ থেকেই বর্ণনাকারী হন এবং বাদপড়া বর্ণনাকারীর নাম প্রকাশ না-করেন, তাহলে তার বর্ণনাটা দয়িফ হিসেবেই বিবেচিত হবে।
উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর যুগে তারাবি বিশ রাকাত পড়া হয়েছে মর্মে কিছু মুরসাল বর্ণনার কথা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। ইয়াযিদ ইবনু খুসাইফাহর সূত্রে একটি মুত্তাসিল বর্ণনাও পেশ করেছিলাম। সবগুলোর বিবরণ একই রকম যে, তাঁর যুগে বিশ রাকাত পড়া হতো। অপরদিকে মুহাম্মাদ ইবনু ইউসুফের বর্ণনা, যেটি সহিহ, তাতে রয়েছে—উমার এগারো রাকাতের নির্দেশ দিয়েছেন। উমারের এগারো রাকাতের নির্দেশনাসংবলিত বর্ণনা এবং তাঁর যুগে বিশ রাকাত পড়া হতো মর্মের বর্ণনাগুলোর মাঝে মূলত কোনো পার্থক্য নাই। উলামা কিরাম উভয়প্রকার (এগারোর নির্দেশ ও বিশ পড়া হতো) বর্ণনাকে তাতবিক (সমন্বয়) দিয়েছেন। এর সারমর্ম হলো—খলিফা উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু নির্দেশ দিয়েছিলেন এগারো রাকাতেরই। তাঁর নির্দেশিত এগারো রাকাত এমন ছিল, যা সারারাতব্যাপী দীর্ঘ কিয়ামের মাধ্যমে আদায় করা হতো। মুসল্লিগণ দীর্ঘ কিয়ামের কষ্টের কারণে হাতে লাঠি নিয়ে তাতে ভর দিয়ে দাঁড়াতেন। পরবর্তীকালে কষ্ট লাঘবের জন্য রাকাতসংখ্যা বাড়িয়ে এগারো থেকে বিশ এবং বিশ থেকে নিয়ে ছত্রিশ রাকাত পর্যন্ত আদায় করেছেন। এ প্রসঙ্গে ইমামদের বক্তব্যগুলো পেশ করা হলো। ইমাম বাইহাকি বলেন,
ويُمكِنُ الجَمعُ بَينَ الرِّوايَتَينِ، فإِنَّهُم كانوا يَقومونَ بإِحدَى عَشْرَةَ، ثم كانوا يَقومونَ بعِشرينَ ويوتِرونَ بثَلاثٍ
‘উভয় বর্ণনার সমন্বয় এভাবে—প্রথমে তাঁরা এগারো রাকাতই পড়তেন, তারপর বিশ রাকাত ও তিন রাকাত বিতর পড়েছেন।’ [আস-সুনানুল কুবরা : ৪৬৮০]
ইমাম ইবনু আবদিল বার বলেন,
أنه يحتمل أن يكون القيام في أول ما عمل به عمر بإحدى عشرة ركعة ، ثم خفف عليهم طول القيام ، ونقلهم إلى إحدى وعشرين ركعة ، يخففون فيها القراءة ويزيدون في الركوع والسجود
‘সম্ভাবনা আছে, উমারের প্রথম আমল এগারো রাকাতের সালাতই ছিল। তারপর দীর্ঘ কিয়ামকে লোকদের জন্য হালকা করে একুশ রাকাতে নিয়ে এসেছেন। এতে কিরাআতকে হালকা করেছেন এবং রুকু-সাজদাহ বাড়িয়ে দিয়েছেন।’ [আল-ইসতিযকার : ২/৬৮ : ২২১]
সুলাইমান ইবনু খালফ আল-বাজি বলেন,
وأمرهم بطول القراءة يقرأ القارئ بالمئين في الركعة لأن التطويل في القراءة أفضل الصلاة فلما ضعف الناس عن ذلك أمرهم بثلاث وعشرين ركعة على وجه التخفيف عنهم من طول القيام
‘উমার তাদেরকে দীর্ঘ কিরাআতের আদেশ করেছিলেন। তাই কারি সাহেব এক রাকাতে দুইশো আয়াত পাঠ করতেন। কারণ, দীর্ঘ কিরাআতই উত্তম সালাত। কিন্তু লোকেরা যখন এতে দুর্বল হয়ে গেল, তিনি তাদের দীর্ঘ কিয়ামকে হালকা করতে তেইশ রাকাতের আদেশ করলেন।’ [আল-মুনতাকা শারহুল মুয়াত্তা, প্রাগুক্ত]
ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ এগারো রাকাতের আলোচনার পর বলেন,
فهو محمول على أنه كان في بداية الأمر ، ثم خُفِّفَ بعدُ على الناس ، فزاد عمر الركعات إلى عشرين ليخفف على الناس القراءة في القيام
‘এটি প্রথম অবস্থায় ছিল। তারপর লোকদের জন্য হালকা করে দেয়া হলো। তাই উমার রাকাত বাড়িয়ে বিশ পর্যন্ত করে ফেললেন, যাতে তাদের জন্য কিয়ামের কিরাআত হালকা হয়।’ [আল-ইখতিয়ারাত : ৬৪]
তিনি আরও বলেন,
كان يقوم بالليل إحدى عشرة ركعة أو ثلاث عشرة ، ثم بعد ذلك كأن الناس بالمدينة ضعفوا عن طول القيام ، فكثروا الركعات ، حتى بلغت تسعا وثلاثين
‘উবাই ইবনু কাব এগারো কিংবা তেরো রাকাত কিয়ামুল লাইল আদায় করতেন। তারপর দীর্ঘ কিয়ামের কারণ মদিনায় লোকেরা দুর্বল হয়ে পড়লে তাঁরা রাকাতসংখ্যা বৃদ্ধি করে উনচল্লিশ রাকাতে নিয়ে গেলেন।’ [মাজমুয়ুল ফাতাওয়া : ২৩/১১৩]
আর পরবর্তীকালে তারাবি বিশ রাকাতেও বহাল থাকেনি; বিতরসহ ঊনচল্লিশ রাকাত পর্যন্ত পড়া হতো। দাউদ ইবনু কাইস বলেছেন,
أَدْرَكْتُ النَّاسَ بِالْمَدِينَةِ فِي زَمَنِ عُمَرَ بْنِ عَبْدِ الْعَزِيزِ، وَأَبَانَ بْنِ عُثْمَانَ يُصَلُّونَ سِتًّا وَثَلَاثِينَ رَكْعَةً وَيُوتِرُونَ بِثَلَاثٍ
‘উমার ইবনু আবদিল আযিয ও আবান ইবনু উসমানের যুগে মদিনাতে লোকদের দেখেছি, তাঁরা ছত্রিশ রাকাত (তারাবিহ) ও তিন রাকাত বিতর পড়তেন।’ [মুসান্নাফু ইবনি আবি শাইবাহ : ৭৬৮৯]
ইমাম মালিক মদিনার অধিবাসী ছিলেন। তাঁর যুগেও মদিনার মসজিদে এ রকমই পড়া হতো। তিনি বলেন,
بَعَثَ إلَيَّ الْأَمِيرُ وَأَرَادَ أَنْ يُنْقِصَ مِنْ قِيَامِ رَمَضَانَ الَّذِي كَانَ يَقُومُهُ النَّاسُ بِالْمَدِينَةِ، وَهُوَ تِسْعَةٌ وَثَلَاثُونَ رَكْعَةً بِالْوِتْرِ سِتٌّ وَثَلَاثُونَ رَكْعَةً وَالْوِتْرُ ثَلَاثٌ، فَنَهَيْته أَنْ يُنْقِصَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا، وَقُلْتُ لَهُ: هَذَا مَا أَدْرَكْتُ النَّاسَ عَلَيْهِ وَهَذَا الْأَمْرُ الْقَدِيمُ الَّذِي لَمْ تَزَلْ النَّاسُ عَلَيْهِ
‘মদিনায় লোকেরা কিয়ামু রমাদান যে পরিমাণ আদায় করত, তৎকালীন আমির আমার কাছে লোক পাঠিয়ে রাকাতের পরিমাণ তা থেকে কমিয়ে দিতে চাইল। তা ছিল বিতরসহ উনচল্লিশ রাকাত—ছত্রিশ রাকাত তারাবি ও তিন রাকাত বিতর। আমি তা কমাতে বারণ করলাম এবং বললাম—এই আমলের ওপর আমি মদিনাবাসীকে পেয়েছি; এটিই পুরনো আমল যার ওপর তাঁরা সবসময়ই আমল করে এসেছেন।’ [আল-মুদাওয়ানাহ, অধ্যায় : কিয়ামু রমাদান, ১/২৮৭]
সুস্পষ্ট যে, তারাবির রাকাতসংখ্যা কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণে সীমাবদ্ধ নয়। যে যত রাকাত ইচ্ছা, আদায় করতে পারে। এ জন্যই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতের সালাত ‘দুই দুই’ বলে বিষয়টি ব্যাপক করে দিয়েছেন। আর বিশ রাকাতের ওপর সীমাবদ্ধ থেকে ইজমাও হয়নি, যা আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি। নয়তো মদিনার মসজিদেই তাঁরা ছত্রিশ রাকাত আদায় করতেন না। সালাতটি ফরজ-ওয়াজিবও নয়; বরং সুন্নাহ। এমন নয় যে, কেউ তারাবিহ না-পড়লে গুনাহগার হবে। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বাকবিতণ্ডা, ঝগড়া-বিবাদ, বাহাস-মুনাযারা এবং একে অপরকে গালাগালি করা সম্পূর্ণই গর্হিত ও শরিয়াহবিরোধী কাজ।