লেখক: ইশতিয়াক আহমেদ সাঈফ
এই প্রবন্ধটি কল্পনা দিয়েই শুরু করা যাক!
চার লেনের রাস্তায় দ্রুত গতিতে চলছে আপনার প্রাইভেট কার। হঠাৎ একশ মিটার সামনে দিয়ে এক পথচারী রাস্তা পার হবার জন্য দৌড় দিলেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে আপনি গাড়ির হার্ড ব্রেক চেপে বসলেন। এতে কোনোভাবে পথচারী, আপনি ও আপনার গাড়ি অক্ষত থাকলেও আপনি যেই ঝাঁকুনিটা ‘উপভোগ’ করেছেন, সেটা নিয়ে হয়তো আরেকটি গল্প লেখা যাবে; তবে আমরা আজ ভিন্ন গল্প শুনব।
আচ্ছা এই যে গাড়িটি গতিশীল অবস্থা থেকে খু্ব অল্প সময়ে স্থিরাবস্থায় পৌঁছে গেল, এই সময়ব্যাপী গাড়ির গতিকে কি আপনি মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়া নিউটনের গতির সমীকরণ দিয়ে প্রকাশ করতে পারবেন? (আমরা জটিলতা এড়াতে গাড়ির গতিকে একমাত্রিক গতি হিসেবে বিবেচনা করব।)
উত্তর হবে ‘না।’ কেন ‘না?’
কারণ, গাড়ির ক্ষেত্রে সুষম ত্বরণ (আলোচ্য ক্ষেত্রে সুষম মন্দন) ঘটেনি; বরং সময়ের সাথে সাথে ত্বরণের পরিবর্তন হয়েছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির পদার্থবিজ্ঞান পাঠ্যবইয়ে আমরা কয়েকটি গতির সমীকরণ সম্পর্কে পড়েছি। তবে সেখানে সমত্বরণে গতিশীল বস্তুর কথা বিবেচনা করা হয়েছে।
মনে করি সম ত্বরণে গতিশীল একটি বস্তু
আদি সরণ ও
আদি বেগ নিয়ে যাত্রা শুরু করে
সময় পর
সরণ ও
শেষ বেগপ্রাপ্ত হয়। এ ক্ষেত্রে,

চিত্র: সমত্বরণে গতিশীল বস্তুর ক্ষেত্রে গ্রাফ
কিন্তু যদি সময়ের সাথে সাথে ত্বরণের পরিবর্তন ঘটে তখন?
আজকের এই আর্টিকেলে আমি গাণিতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সময়ের সাপেক্ষে সরণের আরও উচ্চতর ডেরিভেটিভগুলো নিয়ে আলোচনা করব। ধৈর্য ও মনোযোগসহ পড়তে থাকুন!
সময়ের সাথে ত্বরণের পরিবর্তনকে পদার্থবিজ্ঞানে Jerk (জার্ক) বলা হয়। Jerk কে j দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
এখানে, : অতিক্রান্ত সময়
: সম জার্ক
: আদি ত্বরণ
: চূড়ান্ত ত্বরণ
: আদি বেগ
: চূড়ান্ত বেগ
: আদি সরণ
: চূড়ান্ত সরণ

কিন্তু, যদি জার্ক সুষম না হয়? যদি সময়ের সাথে সাথে জার্ক-এর পরিবর্তন ঘটে?
সময়ের সাথে জার্ক-এর পরিবর্তনকে পদার্থবিজ্ঞানে বলা হয় Snap (স্ন্যাপ)। Snap-কে s দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
এখানে, : সম স্ন্যাপ
: আদি জার্ক
: চূড়ান্ত জার্ক

কিন্তু যদি স্ন্যাপ সুষম না হয়? সময়ের সাথে সাথে স্ন্যাপ-এর পরিবর্তনও হতে পারে, তাই না?
সময়ের সাথে স্ন্যাপ-এর পরিবর্তনকে পদার্থবিজ্ঞানে বলা হয় Crackle (ক্র্যাকল)। Crackle-কে c দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
এখানে, : সম ক্র্যাকল
: আদি স্ন্যাপ
: চূড়ান্ত স্ন্যাপ

কিন্তু যদি ক্র্যাকল সুষম না হয়? যদি সময়ের সাথে সাথে ক্র্যাকল-এর পরিবর্তন ঘটে?
সময়ের সাথে ক্র্যাকল-এর পরিবর্তনকে পদার্থবিজ্ঞানে বলা হয় Pop (পপ)। Pop-কে p দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
এখানে, : সম পপ
: আদি ক্র্যাকল
: চূড়ান্ত ক্র্যাকল

দারুণ! তাই না?
এখন সময়ের সাথে যদি পপ-এর পরিবর্তন ঘটে?
সময়ের সাপেক্ষে সরণের আরও উচ্চতর ডেরিভেটিভের জন্য কোনো নামকরণ এখনো তেমন প্রচলিত হয়নি।
সুতরাং আসুন এবার আমরা একটা সাধারণ সমীকরণ দাঁড় করি।
সম -তে গতিশীল একটি বস্তুর ক্ষেত্রে,
এখন যদি হয় এবং
হয়,
তবে আমরা পাবো,

এর সসীম মানের জন্য
এর মান সসীম হয়। সুতরাং ওপরের ক্ষেত্রে
এর সসীম মানের জন্য
এর মান সসীম হবে।
সরণ নির্ণয় করতে গিয়ে এর উপস্থিতি আপনাদের কাছে অবাক ঠেকতে পারে; আসলেই তো! এখানে কেনই বা
এর আগমন ঘটতে গেল? শুধু তাই নয়; আলোচ্য ক্ষেত্রে বেগ, তরণ, জার্ক, স্ন্যাপ, ক্র্যাকল, পপ ইত্যাদির মান
এর সমান।গবেষণা করতে থাকুন! এটা নাহয় পাঠকের জন্য অনুশীলন হিসেবে থাকল।
প্রিয় পাঠক, আজকের এই প্রবন্ধটি শেষ করা যাক একটি থট এক্সপেরিমেন্ট দিয়ে।
মনে করুন একটি গাড়ি স্থির অবস্থানে আছে। এই মুহূর্তে তার সরণ শূন্য, বেগ শূন্য, ত্বরণ শূন্য, জার্ক শূন্য ইত্যাদি ইত্যাদি। হঠাৎ করে গাড়িটি চলতে শুরু করল। একদম ঠিক চলা শুরু করার আগমুহূর্তে আপনি সময় গণনা শুরু করলেন।
ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সময় পর গাড়িটির
সরণ হলো। আদি সরণ শূন্য ছিল,
সময়ে হয়েছে
। তার মানে সময়ের সাথে সরণ ঘটেছে।
সময়ের সাপেক্ষে সরণের হার হচ্ছে বেগ। অশূন্য বেগ থাকলেই একটি গাড়ির সরণ ঘটা সম্ভব। অর্থাৎ সময় পর তার নিশ্চয় কোনো অশূন্য বেগ ছিল।
আচ্ছা একদম শুরুতে বেগ ছিল শূন্য, সময় পর সে অশূন্য কোনো বেগপ্রাপ্ত হয়েছে। সময়ের সাথে বেগের পরিবর্তন মানে ত্বরণ, অর্থাৎ
সময় পর অবশ্যই গাড়িটির ত্বরণ রয়েছে। কারণ, ত্বরণ না-থাকলে বেগের পরিবর্তন ঘটা সম্ভব নয়।
মজার বিষয়টি এখানেই। খেয়াল করে দেখুন আদি ত্বরণ শূন্য, কিন্তু সময়ে তার ত্বরণ কোনো অশূন্য মান। অর্থাৎ সময়ের সাথে ত্বরণের পরিবর্তন হয়েছে। ত্বরণের পরিবর্তন হওয়া মানে অশূন্য জার্ক-এর উপস্থিতি।
এভাবে এগুতে থাকলে আমরা দেখবো সময় পরে এর অশূন্য স্ন্যাপ রয়েছে, অশূন্য ক্র্যাকল রয়েছে, অশূন্য পপ রয়েছে ইত্যাদি।এর শেষ কোথায়?
এর শেষ হচ্ছে অসীমে! অর্থাৎ আমরা যদি এর সাপেক্ষে
-তম ডেরিভেটিভ নির্ণয় করতে পারি যেখানে
, তবে আমরা ধ্রুবক পাবো, এর আগে নয়। মনে করি,
-তম ডেরিভেটিভ
যেহেতু
এখন প্রশ্ন থাকতে পারে, বাস্তব জীবনে তো কখনো আমরা এভাবে হিসেব করি না; এর কারণ কী?
কারণ হচ্ছে, সময়ের সাপেক্ষে সরণের উচ্চতর ডেরিভেটিভগুলোর মান সাধারণত এতই ছোট হয় যে, আমরা সেগুলোকে শূন্য ধরে নেই। আর সাধারণ হিসেব নিকেশে এত সূক্ষ্মতার প্রয়োজন পড়ে না। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ সূক্ষ্মতার প্রয়োজনে জার্ক কিংবা খুব বড়জোর স্ন্যাপ-এর মান বিবেচনায় আনা হয়, এর বেশি নয়।
বাস্তব জীবনে নাই বা প্রয়োজন হলো, ভবিষ্যতের প্রয়োজনে এবং কল্পনার জগতের রহস্যে ঘেরা সম্পদ আহরণে সময়ের সাপেক্ষে সরণের উচ্চতর ডেরিভেটিভ নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা করা যেতেই পারে, তাই নয় কি?