সাদাকাতুল ফিতর : খাদ্যদ্রব্য না কি টাকা?

উসতায শাইখুল ইসলাম

 

সাদাকাতুল ফিতর হলো বান্দার ওপর আরোপিত রমাদানের সাওমের কাফফারা। পুরো মাসব্যাপী সাওম-পালনে যত ত্রুটিবিচ্যুতি হয়েছে ও সাওমের হক পুরোপুরি আদায়ে যে ঘাটতি হয়েছে, এর কাফফারা হিসেবে এবং অভাবগ্রস্ত ও গরিবদেরকে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে নিবৃত রাখতে ঈদের দিন কিছু খাদ্যদ্রব্য দান করার নাম সাদাকাতুল ফিতর।

ইবনু আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘সাওম অবস্থায় পরচর্চা ও অত্যাধিক কথাবার্তায় লিপ্ত ব্যক্তির পরিশুদ্ধি লাভের উপায় এবং মিসকিনদের জন্য সাদাকাহ হিসেবে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাকাতুল ফিতর আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন।’ (সুনানু আবি দাউদ, কিতাবুয যাকাত, হাদিস নং : ১৬০৯; ইবনু মাজাহ, হাদিস নং : ১৮২৭)। আল-হাকিম ‘মুসতাদরাক (হাদিস নং : ১৪৮৮)’-এ একে সহিহ সাব্যস্ত করেছেন।

এখন প্রশ্ন হলো, খাদ্যদ্রব্যের বদলে টাকা দিয়ে যাকাতুল ফিতর আদায় করা যাবে কি না? এ বিষয়টি নিয়ে আলিমদের মাঝে বড় ধরনের মতপার্থক্য রয়েছে। একদল আলিম বলেন, খাদ্যদ্রব্য দিয়েই আদায় করতে হবে। অপর দল আলিমের বক্তব্য হলো, খাদ্যদ্রব্য ও নগদ টাকা-পয়সা দিয়েও তা আদায় করা যায়।

এ মতভেদটি শুধু নগদ অর্থ দিয়ে আদায়ের ক্ষেত্রেই নয়; বরং সাহাবিদের যুগে হাদিসে নির্দেশিত বস্তু ব্যতীত অন্য খাদ্যদ্রব্য দিয়ে আদায় করার ব্যাপারেও দ্বিমত হয়েছিল। যেমন, হাদিসে খেজুর ও যবকে উল্লেখ করা হয়েছে, যেহেতু মদিনায় তখন এগুলোই পাওয়া যেত। পরবর্তীকালে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর যুগে শামে গমের উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় তিনি গম দিয়ে যাকাতুল ফিতর আদায়ের নির্দেশ দেন। যদিও আবু সায়িদ খুদরি (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এটি মেনে নেননি। তিনি মদিনার আগের খাদ্যদ্রব্য খেজুর ও যবকেই যাকাতুল ফিতর হিসেবে আদায় করতেন। কারণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দুটোরই নামোল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আবু সায়িদ খুদরি (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,

فَلَمَّا جَاءَ مُعَاوِيَةُ وَجَاءَتِ السَّمْرَاءُ ، قَالَ : أُرَى مُدًّا مِنْ هَذَا يَعْدِلُ مُدَّيْنِ

‘মুয়াবিয়ার যুগে যখন গম আমদানি হয়, তিনি বললেন—এক মুদ গম দুই মুদের সমপরিমাণ বলে আমার মনে হয়।’ (সহিহ বুখারি : ১৫০৮)

তিনি আরও বলেন,

فَأَمَّا أَنَا، فَلَا أَزَالُ أُخْرِجُهُ كَمَا كُنْتُ أُخْرِجُهُ أَبَدًا مَا عِشْتُ

‘আমি যতদিন জীবিত থাকব, ততদিন আগের মতো যে পরিমাণে ও যে নিয়মে দিচ্ছিলাম সেভাবেই দিতে থাকব।’ (সহিহ মুসলিম : ৯৮৫)। পরবর্তীকালে উমার ইবনু আবদিল আযিয (রাহিমাহুল্লাহ)-এর যুগে লোকদের মাঝে নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় তিনি অর্থ দিয়েই যাকাতুল ফিতর আদায়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে কুররা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

جَاءَنَا كِتَابُ عُمَرَ بْنِ عَبْدِ الْعَزِيزِ فِي صَدَقَةِ  الْفِطْرِ : نِصْفُ صَاعٍ عَنْ كُلِّ إِنْسَانٍ أَوْ قِيمَتُهُ نِصْفُ دِرْهَمٍ فِي إِعْطَاءِ الدَّرَاهِمِ فِي زَكَاةِ الْفِطْرِ

‘সাদাকাতুল ফিতরের ব্যাপারে আমাদের কাছে এই মর্মে উমার ইবনু আবদিল আযিযের চিঠি এলো, যাকাতুল ফিতরে প্রতিটি লোকের পক্ষ থেকে অর্ধেক সা অথবা এর মূল্য দিরহামে আদায়ের ক্ষেত্রে অর্ধেক দিরহাম দিতে হবে।’ (মুসান্নাফু ইবনি আবি শাইবাহ : ১০৩৬৯)।

 স্পষ্ট যে, মানুষের প্রয়োজনের দিক বিবেচনা করেই এতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর যুগে গমের উৎপাদন ও আমদানি বেড়ে যাওয়ায় এর প্রতি মানুষের প্রয়োজনও বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাই তিনি অর্ধেক সা গমকে এক সা যবের সমপরিমাণ নির্ধারণ করেন। যদিও কোনো কোনো সাহাবি এটি মেনে নেননি। তারপর যখন মুদ্রার প্রতি মানুষের ঝোঁক ও চাহিদা বেড়ে গেল, তখন লোকদের প্রয়োজনের দিক বিবেচনা করেই উমার ইবনু আবদিল আযিয (রাহিমাহুল্লাহ) অর্ধেক দিরহামকে অর্ধেক সার সমপরিমাণ ঘোষণা করেছেন। যদিও তাঁর এই কাজের প্রতি অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেছেন। দ্বিমত থাকতেই পারে। তবে মুয়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ও উমার ইবনু আবদিল আযিযের কর্ম থেকে এটিই প্রমাণিত যে, এই ক্ষেত্রে মানুষের প্রয়োজনের দিকটাই বিবেচ্য। যদিও মুয়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু) যাকাতের ক্ষেত্রে খাদ্যদ্রব্যের বাইরে যাননি, কিন্তু অনেক সাহাবির বিরোধিতা এটাই প্রমাণ করে যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্ধারণ করে যাওয়া কয়েকটি খাদ্যবস্তু দিয়েই যাকাত দিতে হবে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। অথচ মুয়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু) তা করেননি। তার মানে বিষয়টা ব্যাপক। শুধু হাদিসে বর্ণিত বস্তু দ্বারাই যাকাত দিতে হবে এমন নয়। আর মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর যুগে সাহাবিদের ব্যাপক এক অংশ তাঁর নির্দেশনায়ই আমল করেছেন। ইবনু উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন,

فَلَمَّا كَانَ زَمَانُ مُعَاوِيَةَ عَدَلَ النَّاسُ مُدَّيْنِ مِنْ قَمْحٍ بِصَاعٍ  مِنْ شَعِيرٍ

 ‘যখন মুয়াবিয়ার যুগ এলো, লোকেরা দুই মুদ (অর্ধেক সা) গমকে এক সা যবের সমপরিমাণ করে ফেলল।’(সহিহ ইবনু খুযাইমাহ : ২৩৯৩; মুসনাদুল হুমাইদি : ৭১৮)। সহিহ বুখারিতেও বর্ণনাটি আছে (হাদিস নং : ১৫০৭), তবে এতে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর নাম উল্লেখ নেই।

উক্ত বর্ণনায় এ কথা নেই যে, তিনি মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর নির্দেশনা অমান্য করেছেন। যেমন আবু সায়িদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণনায় দেখা যায়। অপরদিকে উমার ইবনু আবদিল আযিয খাদ্যদ্রব্যের বদলে নগদ অর্থ দিয়ে যাকাত আদায়ের নির্দেশনা দিয়ে আরও বাইরে চলে গেলেন। অবশ্য এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, সাহাবিরাও নগদ অর্থ দিয়ে যাকাত আদায় করেছেন। মধ্যম স্তরের তাবিয়ি আবু ইসহাক আস-সাবিয়ি (৩৪-১২৭ হিজরি) বলেন,

أَدْرَكْتُهُمْ وَهُمْ يُعْطُونَ فِي صَدَقَةِ رَمَضَانَ الدَّرَاهِمَ  بِقِيمَةِ الطَّعَامِ

‘আমি সাহাবিদের পেয়েছি, তাঁরা খাদ্যের সমমূল্যের দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) দিয়ে রমাদানের সাদাকা (যাকাতুল ফিতর) আদায় করতেন।’ (মুসান্নাফু ইবনি আবি শাইবাহ, হাদিস নং : ১০৩৭১)। এর সনদ সহিহ।

তাই বিষয়টির ফলাফল দাঁড়াল, যখন যে বস্তুর প্রচলন ও লোকদের যা চাহিদা, তা দিয়েই যাকাতুল ফিতর আদায় করা যায়। অর্থাৎ শুধু হাদিসে বর্ণিত নির্দিষ্ট খাদ্যদ্রব্য দিয়েই আদায় করতে হবে এমন নয়। এর বাইরের খাদ্যদ্রব্য এবং নগদ অর্থ দিয়েও আদায় করা যায়। তবে একটি কথা অবশ্যই বুঝতে হবে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেসব বস্তুর নাম উল্লেখ করেছেন, সেসব দিয়ে যাকাতুল ফিতর আদায় করা অন্য কিছুর চেয়ে উত্তম হবে এবং অন্ততপক্ষে নগদ অর্থের বিবেচনায় খাদ্যদ্রব্যের যাকাত উত্তম হবে। যেহেতু তাঁর যুগে দিনার-দিরহামের প্রচলন থাকা সত্ত্বেও যব ও কিসমিস দিয়ে যাকাতুল ফিতর দেয়ার নির্দেশ করেছেন। তাই এগুলোই উত্তম বলে বিবেচিত হওয়াই যুক্তিযুক্ত। যদিও সালাফরা যাকাতুল ফিতরের বস্তুতে ব্যাপকতা এনেছেন।