তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাত

শাইখ ড. আবদুল্লাহ আযযাম

আল্লাহর সিফাত-পরিচিতি

আমরা জানি আল্লাহর নাম ও গুণগুলো তাওকিফি, অর্থাৎ শুধু ওহির ওপরই নির্ভরশীল―চাই তা কুরআন বা সুন্নাহ থেকে হোক। ইমাম ইবনু খুযাইমাহ (মৃত্যু : ৩৮৬ হিজরি) বলেন,

 ‘হিজায, তিহামাহ, ইয়ামান, শাম ও মিশরসহ আমাদের সব আলিম-উলামার মাযহাব হলো, আমরা আল্লাহর জন্য ওই সব গুণ সাব্যস্ত করি, যা আল্লাহ নিজের জন্য সাব্যস্ত করেছেন। এ বিষয়টি আমরা মুখ দিয়ে স্বীকার করি, হৃদয় দিয়ে সত্যায়ন করি।’[১]

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

لِلَّهِ تِسْعَةٌ وَتِسْعُونَ اسْمًا مِائَةٌ إِلَّا وَاحِدًا لَا يَحْفَظُهَا أَحَدٌ إِلَّا دَخَلَ الْجَنَّةَ وَهُوَ وَتْرٌ يُحِبُّ الْوَتْرَ

‘আল্লাহর নিরানব্বইটি নাম রয়েছে, একটি কম একশতটি। যদি কেউ সেই নামগুলো হিফয (মুখস্থ) করে তাহলে সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে। তিনি বেজোড় তাই বেজোড়কেই বেশি ভালোবাসেন।’[2]

এ ছাড়াও অন্যান্য হাদিসে আরও কিছু নাম এসেছে। তবে আল্লাহর নাম নিরানব্বইটির মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। আবু বাকর ইবনুল আরাবি (রাহিমাহুল্লাহ) ‘শারহুত তিরমিযি’তে একদল আহলুল ইলম (আলিম) থেকে বর্ণনা করেন,

أَنَّهُ جَمَعَ مِنْ الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ مِنْ أَسْمَاءِ اللهِ تَعَالى أَلْفَ اِسْمٍ

‘কিতাব ও সুন্নাহ থেকে তাঁরা আল্লাহর একহাজার নাম ও গুণ আহরণ করেছেন।’[3]

ওইসব নামের মাঝে রয়েছে―الحنان (হান্নান), المنان (মান্নান), البديع (বাদি), الكفيل (কাফিল) ইত্যাদি। কুরআনে বর্ণিত আল্লাহর কিছু গুণ,

وَيَبْقَى وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ

‘ধ্বংস হবে না কেবল তোমার মহামহিম ও চিরসম্মানিত রবের চেহারা।’[সুরা আর-রাহমান, ৫৫ : ২৭]

إِنَّ الَّذِينَ يُبَايِعُونَكَ إِنَّمَا يُبَايِعُونَ اللهَ يَدُ اللهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ

‘যারা তোমার কাছে বাইয়াত করে, বস্তুত তারা আল্লাহর কাছেই বাইয়াত করে। তাদের হাতের ওপর রয়েছে আল্লাহর হাত।’[সুরা আল-ফাতহ, ৪৮ : ১০]

 

সিফাতের মাসআলায় চারটি মাযহাব (মত ও পন্থা)

আল্লাহর সিফাতের ক্ষেত্রে মানুষ চারটি মাযহাবে বিভক্ত :

  ১.  মুশাব্বিহাহ (সাদৃশ্যবাদী) বা মুজাসসিমাহ (দেহবাদী)

তারা আল্লাহর জন্য গুণ সাব্যস্ত করে ঠিকই কিন্তু তারা বলে, আমাদের হাতের মতো আল্লাহর হাত রয়েছে, আমাদের চোখের মতো তাঁরও চোখ রয়েছে, আমাদের মুখের মতো তাঁরও মুখমণ্ডল রয়েছে। এরা হলো দাউদ আল-জাওয়ারিবি, হিশাম ইবনুল হাকাম আর-রাফিদি। এটা মূর্তিপূজার মতোই। এটা কুফর। এ ধরনের আকিদাহ ইসলামের গণ্ডি থেকে বের করে দেয়। এই আয়াত তাদের বিরুদ্ধে বলে,

لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ

‘কোনো কিছুই তাঁর মতো নয়। তিনি সবকিছু শোনেন, সবকিছু দেখেন।’[সুরা আশ-শুরা, ৪২ : ১১ ]

   ২. মুয়াত্তিলাহ[4] ও জাহমিয়াহ[5]

এরা আল্লাহর গুণকে অস্বীকার করে। তাদের ধারণা, আল্লাহ শুনতে পান না, কথা বলতে পারেন না এবং দেখতেও পারেন না। কারণ, এসব কাজ তো অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়। এই ফিরকাটি নির্ঘাত কাফির এবং ইসলামের গণ্ডি থেকে খারিজ। সালাফরা বলেন,

 ‘মুয়াত্তিলারা অস্তিত্বহীনতার পূজা করে আর মুমাসসিলারা (সাদৃশ্যবাদী) মূর্তির পূজা করে।’[৬]

ইমাম ইবনুল কাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

 ‘শিরকের মূল উৎস তাতিল। এর ওপর ভিত্তি করে শিরক মাথাচাড়া দেয়। এই তাতিল তিন প্রকারে বিভক্ত,

  • স্রষ্টাকে সৃষ্টি থেকে তাতিল (নিষ্ক্রিয়) করা।
  • আল্লাহকে তাঁর পবিত্র নাম, গুণ ও কর্ম থেকে তাতিল (নিষ্ক্রিয়) করা।
  • বান্দার ওপর তাওহিদের হাকিকাত আবশ্যকের কারণে আল্লাহ বান্দার সাথে যে মুআমালা (ব্যবহার) করেন বা করবেন, তা থেকে আল্লাহকে তাতিল (নিষ্ক্রিয়) করা।’[7]   

   ৩. সালাফদের আকিদাহ : ইসবাত (সাব্যস্তকরণ)

এই আকিদাহর মূল ভাষ্য হচ্ছে, আল্লাহর গুণগুলো ওইভাবেই প্রয়োগ করা, যেভাবে কুরআন-সুন্নাহয় বর্ণিত হয়েছে। যখন এ ধরনের আয়াতের মুখোমুখি হন― يَدُ اللَّهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ (আল্লাহর হাত তাদের হাতের ওপর)[8], তখন তাঁরা বলতেন, আমরা হাতকে সাব্যস্ত করি, এর প্রতি ইমান রাখি ও সত্যায়ন করি। কিন্তু আমরা এর কাইফিয়াত (ধরন) নিয়ে প্রশ্ন করি না, আবার অস্বীকারও করি না। ইমাম খাত্তাবি (মৃত্যু : ৩৮৮ হিজরি) এই আকিদাহর একটি সারসংক্ষেপ উল্লেখ করেছেন। একখণ্ড সংক্ষিপ্ত মজবুত ভাষ্যে এর ওপর দলিল উপস্থাপন করেছেন। বক্তব্যটি চমৎকার, সুসংক্ষিপ্ত। আমি এখানে তুলে ধরছি। তিনি বলেন,

‘সালাফদের মাযহাব হলো, তাঁরা গুণসংক্রান্ত সব আয়াত ও হাদিসকে এর প্রকাশ্য অর্থের ওপর প্রয়োগ করতেন। সাথে সাথে কাইফিয়াত (ধরন) ও তাশবিহ (সাদৃশ্যকরণ) অস্বীকার করতেন। আল্লাহর সিফাতের ওপর কালাম প্রয়োগ করা মূলত তাঁর মহান সত্তার ওপর কালামের ধারা চালু করার নামান্তর। কারণ, আল্লাহর সত্তার মাঝে যুক্তির পেছনে পড়লে শেষ পর্যন্ত তার সাদৃশ্যের পেছনেও পড়তে হয়। যেহেতু আল্লাহর সত্তাকে সাব্যস্ত করার মানে আল্লাহর অস্তিত্বকেই সাব্যস্ত করা, তাই তাঁর গুণ সাব্যস্ত করার মানেও হলো তাঁর অস্তিত্বকে সাব্যস্ত করা। এটি কোনো ধরনের ধরন সাব্যস্তকরণ নয়। তাঁরা বিষয়টিকে নিজেদের ভাষায় এভাবে ব্যক্ত করতেন যে, গুণগুলো যেভাবে বর্ণিত হয়েছে সেভাবেই প্রয়োগ হবে। কোনোরকম তাওয়িলের (দূরবর্তী ব্যাখ্যা) পেছনে পড়া যাবে না। এ কথার মাধ্যমে তাঁদের উদ্দেশ্য হলো, ধরন-বর্ণনা করা ছাড়াই আল্লাহর গুণ সাব্যস্ত করতে হবে। সালাফদের দিকে সম্বন্ধকারী কিছু লোক ধারণা করে যে, সালাফরা এই কথার মাধ্যমে তাফউইদ (সিফাতের অর্থ না-জানার দাবি, অর্থাৎ সিফাতের অর্থ আল্লাহর কাছে ন্যস্ত করা) উদ্দেশ্য নিয়েছেন অথবা তাদের ধারণা, এগুলো মুতাশাবিহাতের (অস্পষ্ট বা দ্ব্যর্থবোধক) অর্ন্তভুক্ত। এ সবই ভুল ধারণা।’[৯]

ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

‘আল্লাহর ওপর বিশ্বাসের অন্যতম অংশ হচ্ছে, নিজ কিতাবে তিনি নিজেকে যেভাবে বর্ণনা করেছেন এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে তাঁকে গুণান্বিত করেছেন, কোনো প্রকার তাহরিফ, তাতিল, তাকয়িফ এবং তামসিল ছাড়াই এর ওপর ইমান আনা।’[১০]

আবার কেউ কেউ বলেছেন,

‘সামগ্রিকতা ও সাব্যস্তকরণের দিক থেকে আল্লাহর গুণগুলোর অর্থ জানা আছে, তবে ধরন-নির্ধারণ ও সীমাবদ্ধকরণের দিক থেকে তা একেবারেই অবোধগম্য।’[১১]

তাহরিফ (বিকৃতিসাধন) : কোনো নসকে (কুরআন-হাদিস) শব্দগত বা অর্থগতভাবে বিকৃত করা।

তাকয়িফ (ধরন-নির্ধারণ) : كيف শব্দ দ্বারা প্রশ্ন করা। অর্থাৎ এটি কেমন বা কী ধরনের, এ জাতীয় প্রশ্ন করা।

তামসিল (তুলনাকরণ) : কোনো বস্তুর জন্য অন্য একটি বস্তুকে সাদৃশ্যপ্রদান করা, যে বস্তুটি সবদিক থেকে তার মতো হয়।

তাশবিহ (সাদৃশ্যকরণ) : কোনো একটি বস্তুকে অন্য একটি বস্তুর সাথে সাদৃশ্যস্থাপন করা, তবে সে বস্তুটি কিছু কিছু দিক থেকে তার সাথে সাদৃশ্য রাখে।

ইমাম আবুল কাসিম আল-লালাকায়ি ‘উসুলুস সুন্নাহ’ গ্রন্থে ইমাম আবু হানিফার ছাত্র ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণনা করেছেন,

‘দুনিয়ার পূর্ব থেকে পশ্চিমপ্রান্ত পর্যন্ত যত ফুকাহা কিরাম রয়েছেন সবাই একমত পোষণ করেছেন যে, কুরআনের ওপর ইমান আনতে হবে এবং গ্রহণযোগ্য বর্ণনাকারীরা আল্লাহর সিফাতের ব্যাপারে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যেসব হাদিস বর্ণনা করেছেন, কোনো ব্যাখ্যা, ভিন্ন কোনো বিশেষণব্যবহার ও সাদৃশ্যস্থাপন ছাড়াই ওইসব হাদিসের ওপরও ইমান আনতে হবে। আজকের জমানায় কেউ যদি ওগুলোর কোনো ব্যাখ্যা করে, তাহলে সে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে পথের ওপর ছিলেন তা থেকে বের হয়ে গেল এবং সাহাবা আজমায়িনের জামাআত ত্যাগ করল। তাঁরা তো ভিন্ন কোনো বিশেষণ ব্যবহার করেননি, ব্যাখ্যাও করেননি; বরং কুরআন-সুন্নাহয় যা আছে তার ওপরই ফাতওয়া দিয়েছেন, তারপর চুপ থেকেছেন।’[১২]

ইমাম আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

‘তাঁর হাত, মুখ ও সত্তা রয়েছে, যেমনটি আল্লাহ কুরআনুল কারিমে বর্ণনা দিয়েছেন। আল্লাহ যে চেহারা, হাত ও সত্তার আলোচনা করেছেন, সেগুলো কোনো প্রকারের ধরন-নির্ধারণ ছাড়াই তাঁর সিফাত (গুণ)। তাঁর হাতকে কুদরাত (ক্ষমতা) বা নিয়ামাত বলা যাবে না। এমন ব্যাখ্যা করার অর্থ আল্লাহর গুণ বাতিল করে দেয়া। এমন ব্যাখ্যা করা কাদারিয়া ও মুতাযিলাদের মাযহাব[১৩]; বরং হাত তাঁর সিফাত, কোনো ধরন-নির্ধারণ ছাড়া।’[১৪]

আমাদের রব দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন[1৫] এবং আল্লাহ তাঁর পা রাখেন, এ ধরনের নসের (কুরআন-সুন্নাহর বর্ণনা) ক্ষেত্রে ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

‘আমরা এর ওপর ইমান আনি, সত্যায়ন করি, তবে এগুলোর কোনো ধরন নেই, কোনো অর্থও নেই।[16] আমরা এগুলোর কোনো কিছু প্রত্যাখ্যান করি না। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন―যদি সহিহ সনদ দ্বারা বর্ণিত হয়―সবই সত্য। আমরা তাঁর কোনো কথাই প্রত্যাখ্যান করি না। আল্লাহ নিজের ব্যাপারে যে সিফাত বর্ণনা করেছেন―সীমা ও পরিসীমা ছাড়াই―এরচেয়ে বেশি ও বাড়িয়ে বর্ণনা করা করা যাবে না। তাঁর মতো কোনো কিছুই নেই।’[17]

ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) যখন এই আয়াত তিলাওয়াত করতেন, يَدُ اللَّهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ (আল্লাহর হাত তাদের হাতের ওপর)[18], তখন তিনি নিজের হাতের দিকে ইশারা করতেন। অথবা যখন তিনি এই আয়াত তিলাওয়াত করতেন,  وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ (তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা)[19] সুরা আশ-শুরা, ৪২ : ১১ তখন তিনি নিজের চোখ ও কানের দিকে ইশারা করতেন। কারণ, এই ইশারাকৃত অঙ্গের সাথে সাদৃশ্য দিলে তা কেটে দেয়া হবে। এ তো নিজের সাথে আল্লাহকে তুলনা করার নামান্তর।

 ইমাম ফখরুল ইসলাম বাযদাবি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

‘হাত ও চেহারা আমাদের কাছে প্রমাণিত এবং প্রতিষ্ঠিত সত্য। তা মৌলিকভাবেই জ্ঞাত, তবে বর্ণনা করার দিক থেকে সাদৃশ্যপূর্ণ। তাই, কাইফিয়াত (ধরন) বর্ণনা করা থেকে অক্ষম হওয়ার কারণে সিফাত বাতিল করা যাবে না। মুতাযিলারা এই জন্যই পথচ্যুত হয়েছে। তারা যুক্তিগ্রাহ্যভাবে সিফাত সম্পর্কে না-বুঝতে পেরে মূল সিফাতগুলোই প্রত্যাখ্যান করে বসে। ফলে মুয়াত্তিলাহগোষ্ঠীতে পরিণত হয়।’[২০]

   ৪. পরবর্তীদের (খালাফ) আকিদাহ

এই মতের অনুসারীরা আল্লাহকে দেহবাদের দুর্গন্ধ থেকে মুক্ত করার জন্য আল্লাহর কিছু গুণকে ব্যাখ্যা করা বৈধ মনে করতেন। তবে তারা এ ব্যাপারে সালাফদের সাথে একমত যে, আয়াতগুলোর উদ্দেশ্য এমনসব অর্থ ও উদ্দেশ্যের বিপরীত, যা মানুষের মাথায় আসে। আবুল ফারাজ ইবনুল জাওযি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

‘আল্লাহ বলেন,

وَيَبْقَى وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ

“ধ্বংস হবে না কেবল তোমার মহামহিম ও চিরসম্মানিত রবের চেহারা।”[ সুরা আর-রাহমান, ৫৫ : ২৭]

মুফাসসির কিরাম বলেন, এর অর্থ হলো “তোমার রব বাকি থাকবেন।” এমনিভাবে তাঁরা আল্লাহর বাণী يُرِيدُونَ وَجْهَهُ (তারা আল্লাহর চেহারা কামনা করে)-এর তাফসির করেছেন, يريدونه (তারা আল্লাহকে চায়)। এমনিভাবে দাহহাক ও আবু উবাইদাহ كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلَّا وَجْهَهُ (সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে, শুধু তাঁর চেহারা ছাড়া) আয়াতের তাফসির করেছেন إِلَّا هُوَ  (তিনি ছাড়া)।’

ইমাম ইবনুল জাওযি (রাহিমাহুল্লাহ) মনে করতেন, আয়াতের প্রকাশ্য অর্থ গ্রহণ করা সাদৃশ্যবাদ ও দেহবাদের অন্তর্ভুক্ত। শব্দের প্রকাশ্য অর্থের জন্যই তো শব্দটিকে গঠন করা হয়েছে। সুতরাং يد (হাত) শব্দটির হাকিকি (প্রকৃত) অর্থ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ (جارحة) ছাড়া অন্য কিছুই বুঝে আসে না। তিনি বলেন,

‘সালাফদের মানহাজ হচ্ছে, এসব আয়াতের ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করা। তাঁরা কখনোই আয়াতের প্রকাশ্য অর্থ ও মর্ম গ্রহণ করতেন না।’[২১]

 

আমাদের আকিদাহ

সিফাতের ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মাযহাবই আমাদের মাযহাব । এ ব্যাপারে আমরা সালাফদের আকিদাহই গ্রহণ করেছি। যার সারমর্ম হলো, কোনো প্রকার তাওয়িল (দূরবর্তী ব্যাখ্যা), তাতিল (নিষ্ক্রিয়করণ), তাহরিফ (বিকৃতি), তাকয়িফ (ধরন-নির্ধারণ) তামসিল (সাদৃশ্যকরণ) ছাড়াই আল্লাহর সুমহান গুণসহ তাঁর নাম একমাত্র তাঁর জন্যই সাব্যস্ত করা। আমাদের বিশ্বাস, সালাফরা গুণগুলো সাব্যস্ত করতেন, তাফউইদ (সিফাতের অর্থ না-জানার দাবি, অর্থাৎ সিফাতের অর্থ আল্লাহর কাছে ন্যস্তকরণ) করতেন না। আমরা বিশ্বাস করি, তাঁরা আল্লাহর নাম ও গুণাবলিকে মুতাশাবিহ (অস্পষ্ট বা দ্ব্যর্থবোধক)[22] মনে করতেন না; বরং তাঁরা ওগুলোর অর্থ জানতেন, কিন্তু ধরন নিয়ে প্রশ্ন করতেন না।

আমরা এ ব্যাপারে ওই কথাই বলব, যা ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,

اَلْاِسْتِوَاءُ مَعْلُوْمٌ ، وَالْكَيْفُ مَجْهُوْلٌ ، وَالْإِيْمَانُ بِهِ وَاجِبٌ ، وَالسُّؤَالُ عَنْهُ بِدْعَةٌ

‘ইসতিওয়া (আরশের ওপর সমুন্নত হওয়া) জানা বিষয়, তবে ধরন অজ্ঞাত। এর প্রতি ইমান আনা ওয়াজিব, প্রশ্ন করা বিদআত।’[23]

আমরা ইসতিওয়াকে প্রভাব বিস্তারকরণ বা ক্ষমতাগ্রহণ অর্থ করব না। আল্লাহর অবতরণের (নুযুল) বেলায়ও একই কথা। একইভাবে আমরা বলব, তাঁর হাত রয়েছে, তবে আমাদের হাতের মতো নয়। আবার তাঁর হাতকে আমরা ক্ষমতাও (কুদরাত) বলব না। আমরা বলব,

مَذْهَبُ السَّلَفِ أَسْلَمُ وَأَعْلَمُ وَأَحْكَمُ

‘সালাফদের পন্থাই সবচেয়ে নিরাপদ, জ্ঞানগর্ভ ও প্রজ্ঞাময়।’

এ কথা বলব না যে,

مَذْهَبُ السَّلَفِ أَسْلَمُ وَ مَذْهَبُ الْخَلَفِ أَحْكَمُ

‘সালাফদের পন্থা সর্বাধিক নিরাপদ, আর খালাফদের পন্থা সর্বোচ্চ প্রজ্ঞাময়।’

আমরা বলি, সালাফদের মাযহাবই (পন্থা) আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মাযহাব। তাঁর মতো কোনো কিছুই নেই, তিনিই সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। পরবর্তীকালের কিছু আলিম তাওয়িলের পক্ষপাতী ছিলেন। যেমন, আশআরি সম্প্রদায়। তারাও আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের অন্তর্ভুক্ত। তবে সিফাতের তাওয়িলের (দূরবর্তী ব্যাখ্যা) ক্ষেত্রে তারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর অন্তর্ভুক্ত নন। আমাদের বিশ্বাস আশআরিরা কাফির নন, তাওয়িলের কারণে মুসলিম মিল্লাত থেকে খারিজও নন; বরং তারা এ ব্যাপারে ভুল করেছে। বিশেষ করে ইতিহাসে দেখা যায়, মুসলিম উম্মাহর অসংখ্য আলিম-উলামা তাওয়িল করেছেন। তাদের বড় অংশজুড়েই ছিলেন ফিকহ, তাফসির ও ইলমুল হাদিসের উজ্জ্বল নক্ষত্র ও মহান কীর্তিমান সন্তান। সাদৃশ্যবাদ থেকে আল্লাহকে পবিত্র রাখাই তাওয়িলের প্রতি তাদের ঝুঁকে যাবার কারণ।[24] আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদের সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখেন। পদস্খলিত ও পথচ্যুতদের ক্ষমা করেন।

رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ

‘ও রব, পথপ্রদর্শনের পর আমাদের হৃদয়কে বক্র করে দেবেন না। আপনার পক্ষ থেকে দয়া ও অনুগ্রহ দান করুন। আপনিই তো মহানদাতা।’[সুরা আলি ইমরান, ৩ : ৮]

তা ছাড়া অসংখ্য সত্যবাদী ব্যক্তি সালাফদের আকিদাহয় ফিরে এসেছিলেন। তাঁদের মাঝে অন্যতম হলেন আবুল হাসান আশআরি। তিনি এর আগে মুতাযিলাদেরও নেতা ছিলেন। সেই ভ্রান্তি থেকে ফিরে এসে মুতাযিলাদের বিরুদ্ধে তিনশতেরও বেশি বই-বই রচনা করেন। তিনি তাঁর ‘আল-ইবানাহ আন উসুলিদ দিয়ানাহ’ এবং ‘মাকালাতুল ইসলামিয়িন’ গ্রন্থদ্বয়ে নিজ আকিদাহর বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন,

‘আমাদের আকিদাহর সারকথা হলো, আমরা আল্লাহকে স্বীকার করি, তাঁর মালায়িকাহ, কিতাব ও রাসুলদের স্বীকার করি। তাঁরা আল্লাহর পক্ষ থেকে যা নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন, সেগুলোও স্বীকার করি এবং নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীরা যা বর্ণনা করেছেন, তাও স্বীকার করি। আমরা এর কোনো কিছুই প্রত্যাখ্যান করি না। আল্লাহর চেহারা রয়েছে। তিনি বলেছেন,

وَيَبْقَى وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ

“ধ্বংস হবে না কেবল তোমার মহামহিম ও চিরসম্মানিত রবের চেহারা।” [সুরা আর-রাহমান, ৫৫ : ২৭]

তাঁর দুই হাত রয়েছে, তবে ধরন-নির্ধারণমুক্ত। আল্লাহ বলেন,

خَلَقْتُ بِيَدَيَّ

“আমি আমার উভয় হাত দিয়ে তাকে সৃষ্টি করেছি।”[সুরা সাদ, ৩৮ : ৭৫]

بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ

“বরং তাঁর উভয় হাত বিস্তৃত হয়ে আছে।”[সুরা আল-মায়িদাহ, ৫ : ৬৪]

এমনিভাবে তাঁর দুই চোখ রয়েছে, তবে ধরন-নির্ধারণমুক্ত। তিনি বলেন,

تَجْرِي بِأَعْيُنِنَا

“(নৌকাটি) আমার চোখের সামনে ভ্রমণ করবে।”[ সুরা আল-কামার, ৫৪ : ১৪]’[২৫]

________________________

[ ইলমওয়েব পাবলিশিং প্রকাশিত ‘আকিদাহর পরিশুদ্ধি’ বইয়ের চতুর্থ অধ্যায় ]

 

তথ্যসূত্র ও টীকা

[১] কিতাবুত তাওহিদ লি ইবনি খুযাইমাহ, পৃষ্ঠা : ২৬

[২] সহিহ বুখারি : ৬৪১০; সহিহ মুসলিম : ৬৯৮৫; শব্দাবলি বুখারির।

[৩] উসতায হাসানুল বান্না, আল-আকায়িদ, মাজমুয়াতুর রাসায়িল, পৃষ্ঠা : ৯৮৪

[৪] যারা তাতিল করে তাদের মুয়াত্তিলাহ বলা হয়। তাতিল (تعطيل) অর্থ শূন্যকরণ, নিষ্ক্রিয়করণ। পরিভাষায় আল্লাহর কোনো নাম বা সিফাতকে অস্বীকার করা। জাদ ইবনু দিরহাম সর্বপ্রথম তাতিলের সূচনা করে। (দেখুন : শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু সালিহ আল-উসাইমিন, ফাতহু রাব্বিল বারিয়াহ বি-তালখিসিল হামাওয়িয়াহ) [ভাষা-সম্পাদক]

[৫] জাহম ইবনু সাফওয়ানের (মৃত্যু : ১২৮ হিজরি) অনুসারীদের জাহমিয়াহ বলা হয়। তার নামানুসারেই এই সম্প্রদায়ের নামকরণ। বনু উমাইয়াদের শাসনামলের শেষদিকে খুরাসান অন্তর্গত সমরকন্দ থেকে এই সম্প্রদায়ের উৎপত্তি ঘটে। এরা আল্লাহর সকল নাম ও সিফাতকে অস্বীকার করে। এদের মতে ইমান কেবল অন্তরে জানার নাম। মৌখিক স্বীকৃতি ও আমলকে এরা ইমানের অন্তর্ভুক্ত মনে করে না। [ভাষা-সম্পাদক]

[৬] মাজমুয়ুল ফাতাওয়া : ৫/২১৬

[৭] আল-জাওয়াবুল কাফি, পৃষ্ঠা : ৯০

[৮] সুরা আল-ফাতহ, ৪৮ : ১০

[৯] রাওদাতুন নাদিয়াহ, পৃষ্ঠা : ৩২

[১০] আল-আকিদাতুল ওয়াসিতিয়াহ, পৃষ্ঠা : ৮

[১১] শাইখ মুসতাফা আল-আলিম, শারহুল আকিদাতিল ওয়াসিতিয়াহ, পৃষ্ঠা : ১২

[১২] শারহু উসুলি ইতিকাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামাআহ, পৃষ্ঠা : ১৮৬

[১৩] মুতাযিলা ফিরকার প্রতিষ্ঠাতা হলো ওয়াসিল ইবনু আতা ও আমর ইবনু উবাইদ। তাদের দুজনকেই হাসান আল-বাসরি রাহিমাহুল্লাহ কুফার মসজিদে নিজ হালাকা থেকে বের করে দিয়েছিলেন। বনু উমাইয়াদের আমলে এদের সূচনা হলেও আব্বাসীয় খলিফাহ মামুনের যুগেই এদের বিশেষ উত্থান ঘটে। মামুন এদের সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। মুতাযিলারা নিজ বিবেক-আকলকে ওহির ওপর প্রাধান্য দিত, আল্লাহর সিফাত অস্বীকার করত। তাদের মতে কুরআন সৃষ্ট বা মাখলুক। তারা বলত, কবিরা গুনাহকারী মুমিনও নয়, কাফিরও নয়; বরং এ দুয়ের মধ্যবর্তী। এরা মুজিযায় বিশ্বাস করত না। [ভাষা-সম্পাদক]

[১৪] আল-ফিকহুল আকবার, পৃষ্ঠা : ১৬৭-১৬৮ (দারুল কিতাব, বৈরুত, হিজরি : ১৩৯৯)

[১৫] রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমাদের মহামহিম রব প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে দুনিয়ার নিকটবর্তী আসমানে নেমে ঘোষণা করতে থাকেন, “কে আছে ডাকবে আমি সাড়া দেবো? কে আছে কিছু চাইবে আমি দেবো? কে আছে ক্ষমা চাইবে আমি ক্ষমা করবো?”’ (সহিহ বুখারি, কিতাবুত তাহাজ্জুদ : ১১৪৫; সহিহ মুসলিম, কিতাবু সালাতিল মুসাফিরিন ওয়া কাসরিহা : ৭৫৮) [ভাষা-সম্পাদক]

[১৬] ইমামের সম্পূর্ণ বক্তব্যটি আবু বাকর আল-খাল্লাল (মৃত্যু : ৩১১ হিজরি) থেকে বর্ণিত যে, হাম্বল ইবনু ইসহাক বলেছেন,

سَأَلت أَبَا عبد الله عَن الْأَحَادِيث الَّتِي تروى إِن الله تبَارك وَتَعَالَى ينزل كل لَيْلَة إِلَى السمآء الدُّنْيَا وَأَن الله يرى وَإِن الله يضع قدمه وَمَا أشبهه فَقَالَ أَبُو عبد الله نؤمن بهَا ونصدق بهَا وَلَا كَيفَ وَلَا معنى

‘আবু আবদিল্লাহকে (আহমাদ ইবনু হাম্বল) ওইসব হাদিস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, যেগুলো এ বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ প্রতি রাতে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন, আল্লাহকে দেখা যাবে এবং তিনি তাঁর পা রাখেন ইত্যাদি। তখন তিনি বললেন, “আমরা এর ওপর ইমান আনি, সত্যায়ন করি। তবে এগুলোর কোনো ধরন নেই, কোনো অর্থও নেই।”’ (ইমাম ইবনু কুদামাহ, যাম্মুত তাওয়িল, পৃষ্ঠা : ২২; বর্ণনা নং : ৩৩)।

সনদ্গত আলোচনা : বর্ণনাকারী হাম্বল ইবনু ইসহাকের ব্যাপারে রিজালশাস্ত্রের ইমামদের মন্তব্য হলো, কোনো বিষয় বর্ণনা করতে গিয়ে প্রায়ই তাঁর ভ্রম হতো। অনেক মাসআলা বর্ণনায় তিনি এককভাবে অদ্ভুত ও অপরিচিত কথা বর্ণনা করেছেন। তাই ইমাম আহমাদ থেকে তাঁর একক কোনো বর্ণনা মুতাকাদ্দিম (পূর্ববর্তী) হাম্বলিরা নেননি। ইমাম যাহাবি ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’য় বলেছেন, তিনি প্রচুর মাসআলায় ইমাম আহমাদ থেকে এককভাবে অদ্ভুত ও অপরিচিত কথা বর্ণনা করেছেন। ইবনু রজবও একই কথা বলেছেন। এমনকি আবু বাকর খাল্লালও তাঁর একক কোনো বর্ণনা নিতেন না। বর্ণনাটা প্রকৃতপক্ষে শায (ইবনুল মুসিলি, মুখতাসারুস সাওয়ায়িকিল মুরসালাহ লি ইবনিল কাইয়িম, পৃষ্ঠা : ৪৭৫)।

দৃষ্টি আকর্ষণ : এই বর্ণনায় ইমাম আহমাদকে যে কয়টি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে, এর একটি হলো, আল্লাহকে দেখতে পারা। আহলুস সুন্নাহর সবাই একমত, পরকালে আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখা যাবে। গোটা মুসলিম উম্মাহ একমত। কিন্তু ইমামের ‘অর্থ নেই’ কথাটাকে যদি অর্থের তাফউইদ ধরা হয়, তাহলে তো আল্লাহকে দেখতে পারার বিষয়টিও নাকচ করে দিতে হবে। কারণ, এর তো কোনো অর্থই নেই। অথচ বিষয়টি আদৌ এমন নয়। এর সনদগত ত্রুটি সত্ত্বেও বর্ণনার ভাষ্যটা অর্থ ও ধরন নাকচ বোঝায় না। বরং তৎকালীন জাহমিয়াদের বিকৃতি ও ধরন-বর্ণনাকারীদের বিরোধিতা করে কথাটা বলা হয়েছিল। ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ ‘দারউত তাআরুদ’-এ ইমাম আহমাদের উপর্যুক্ত বক্তব্যের অর্থ স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন যে,

ولا كيف ولا معنى؛ أي: لا نُكيِّفها، ولا نُحرِّفها بالتأويل، فنقول: معناها كذا

‘“কাইফ নেই” কথাটার অর্থ হলো, আমরা কোনো ধরন সাব্যস্ত করতে যাই না। আর “অর্থ নেই” কথার অর্থ হলো, তাওয়িল করে আমরা সিফাতকে বিকৃত করি না। বরং আমরা বলি, এর অর্থ হলো এটি।’ (দারউ তাআরুদিল আকলি ওয়ান নাকলি : ২/৩১)।

প্রকাশ্য অর্থে সিফাত সাব্যস্তকরণ : ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বলকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল,

الله فوق السماء السابعة على عرشه، بائن من خلقه، وعلمه وقدرته بكل مكان؟

‘আল্লাহ কি সাত আসমানের ঊর্ধ্বে তাঁর আরশের ওপর, তাঁর সৃষ্টি থেকে আলাদা, তাঁর জ্ঞান ও ক্ষমতা সর্বত্র?’ তিনি জবাবে বললেন,

نعم هو على عرشه ولا يخلو شيء من علمه

‘হাঁ, তিনি তাঁর আরশের ওপর, কোনোকিছু তাঁর জ্ঞানের অগোচরে নয়।’

(ইমাম লালাকায়ি, শারহু উসুলি ইতিকাদি আহলিস সুন্নাহ, খণ্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ৪০১, বর্ণনা নং : ৬৭৪)।

ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল আরও বলেছেন,

إن لله تعالى يدان وهما صفة له في ذاته

‘মহান আল্লাহর দুই হাত রয়েছে। এ দুই হাত তাঁর সত্তাগত সিফাত।

(আহমাদ ইবনু হাম্বল, আল-আকিদাহ, আবু বাকর খাল্লালের বর্ণনা, পৃষ্ঠা : ১০২-১১১) [নিরীক্ষক]

[১৭] কিতাবুল আরশ, পৃষ্ঠা : ১১৫

[১৮] সুরা আল-ফাতহ, ৪৮ : ১০

[১৯] সুরা আশ-শুরা, ৪২ : ১১

[২০] ইদাহুদ দালিল, পৃষ্ঠা : ৪১

[২১] দাফয়ু শুবহাতিত তাশবিহ, পৃষ্ঠা : ১৫৩

[২২] মুতাশাবিহের অর্থ একমাত্র আল্লাহই জানেন। কুরআনের বিচ্ছিন্ন হারফগুলো (হুরুফুল মুকাত্তাআত) মূলত মুতাশাবিহাত। যেমন, ইয়া-সিন, আলিফ-লাম-মিম ইত্যাদি। এগুলো অর্থগতভাবেই মুতাশাবিহ। আল্লাহ ছাড়া এগুলোর অর্থ কেউ জানে না। [ভাষা-সম্পাদক]

[২৩] ইমাম মালিকের বিখ্যাত উক্তিটি একাধিক সনদে বর্ণিত। কিছু সূত্রে ভিন্ন শব্দে বর্ণিত হলেও সবগুলোর মর্মার্থ একই। এর কিছু সনদে দুর্বলতা থাকলেও ইমাম মালিকের প্রায় দশজন ছাত্র থেকে একাধিক সনদে বর্ণিত হওয়ায় দুর্বলতা কেটে গেছে। কয়েকটি বর্ণনা তো সহিহ সনদেও বর্ণিত হয়েছে। সহিহ সনদের একটি বর্ণনা,

الاستواء غير مجهول، والكيف غير معقول، والإيمان به واجب، والسؤال عنه بدعة

‘ইসতিওয়া অজ্ঞাত নয়, তবে এর ধরন অবোধগম্য। এর প্রতি ইমান আনা ওয়াজিব, প্রশ্ন করা বিদআত।’ (ইমাম আল-বাইহাকি, আল-আসমা ওয়াস-সিফাত : ৮৬৭ নং বর্ণনা; ইমাম আল-বাইহাকি, আল-ইতিকাদ, অধ্যায় : আল-কওলু ফিল-ইসতিওয়া, পৃষ্ঠা নং : 116)।

এটি ইমাম মালিক থেকে ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহইয়া আত-তামিমি সরাসরি বর্ণনা করেছেন। ইমাম বাইহাকি নিজ সনদে তা উল্লেখ করেছেন। ইমাম যাহাবি বলেন―ইমাম মালিক থেকে এ বর্ণনা প্রমাণিত। (আল-উলু : 378 নং বর্ণনা)। ইমাম মালিক থেকে অনুরূপ শব্দে মুহাম্মাদ ইবনু নুমান ইবনি আবদিস সালাম আত-তাইমিও বর্ণনা করেছেন―তাবাকাতুল মুহাদ্দিসিন, অধ্যায় : ৭ম তাবাকাহ, বর্ণনা নং : ১৫৪। এই সনদ জাইয়িদ (ভালো)। [নিরীক্ষক]

[২৪] মূলত আল্লাহর সিফাতের ব্যাপারে জাহমিয়া ও মুতাযিলাদের ভ্রান্তি খণ্ডন করতে গিয়েই তারা তাওয়িল করেছিলেন। তা একটি সময়ে নির্দিষ্ট একটি কারণকে সামনে রেখেই করা হয়েছিল। যদিও এ ক্ষেত্রে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের মতো অন্যান্য সালাফের নীতি ছিল একদম বিশুদ্ধ যে, তাওয়িল করে ওদেরকে মানাতে বাধ্য করা আমাদের দায়িত্ব নয়; বরং নুসুসে যা যেভাবে আছে, সেভাবেই বলে যেতে হবে। যেহেতু নির্দিষ্ট একটি কারণকে সামনে রেখে তারা এমনটা করেছিলেন, তাই তাদের উক্ত কাজ স্থায়ীভাবে আঁকড়ে ধরে থাকা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বিশেষ করে এ সাময়িক কাজ অকাট্যরূপে গ্রহণ করা সুস্পষ্ট পদস্খলন, যা আহলুস সুন্নাহ ও সালাফের মানহাজ-বহির্ভূত। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ক্ষমা করুন। [নিরীক্ষক]

[২৫] আল-ইবানাহ, পৃষ্ঠা : ২১-২২

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *