নারীবাদ প্রসঙ্গ : শিক্ষিত নারীদের করার কিছুই নেই?

এস এম সাওয়াবুল্লাহ্‌ হক

 

মুসলিম-সমাজকে যে প্রশ্ন দিয়ে সবচেয়ে বেশি দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়া হয় তা হলো, নারীর অধিকার। বিগত দশক ধরে যেন আমাদের সমাজকে নারী নিয়েই প্রশ্নবিদ্ধ করার খেলায় মেতেছে সেক্যুলার সমাজ। তাদের লিবারেল আদর্শকে মাপকাঠি বা স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ধরে নিয়ে আমাদের দৃঢ় প্রাচীরসম গড়ে তোলা সামাজিক শৃঙ্খলকে দুর্বল করে তুলছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, তাদের এই কার্যক্রম বা এজেন্ডা বাস্তবায়নের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার আমাদের নারীরাই। কারণ, সাম্রাজ্য তাদের হওয়ার কারণে শিক্ষা ও প্রগতির নাম দিয়ে আমরা তাদের হাতেই আমাদের নারীদের তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছি আর তারাও আমাদের এই অসহায়ত্বকে কাজে লাগিয়ে যেভাবে পারা যায় আমাদের ঘরের মেয়েদের মগজধোলাই (ব্রেইনওয়াশ) করে দিচ্ছে পাশ্চাত্যের বস্তাপচা নানা মতবাদ ও মতাদর্শ দিয়ে। তারা মেয়েদের লজ্জা ভেঙে দিচ্ছে। মেয়েদের অদ্ভুত সব শব্দ ও পরিভাষা (term) শেখাচ্ছে। মেয়েরা নতুন নতুন সেক্যুলার মতাদর্শে প্রভাবিত হয়ে নিজেদেরকে নতুন করে আবিষ্কার করতে শিখছে। এরপর সে সমাজ ও সমাজের মানুষকে জীবন যাপন করছে শত্রুজ্ঞান করে। এখন নারীবাদিতা ছড়াচ্ছে খোদ মুসলিম পরিবারের নারীরাই। কেউ কয়েকটা টাকার লোভে এনজিয়োতে চাকরি করে নারীবাদিতা ছড়াচ্ছে, আর কেউ নিজ থেকেই সময় নষ্ট করে সোশ্যাল মিডিয়াতে একের পর এক নারীবাদী লেখা লিখে নিজের দল ভারী করার চেষ্টায় আছে। তার যেন কোনো এক মাইলফলক ছুঁতে হবে। সে থামতে চাচ্ছে না। সমাজের সব নারীকে সে টার্গেট করছে। যারা তার আদর্শের সাথে মানতে নারাজ তাদেরকে বোকা ও অন্ধকারের পথিক সাব্যস্ত করছে। তাদের ভাব অনেকটা এ রকম যে, আমাদের যে নারীরা তাদের পথসাথি হয়নি, তারা কোনো এক অজানা সিন্ড্রোমে ভুগছে। যে সিন্ড্রোমে ভুগলে রোগী তার অসহায়ত্ব বুঝে উঠতে পারে না। অনেকটা স্টকহোম সিন্ড্রোমের মতো, যেখানে যাকে কিডন্যাপ করা হয় সে-ই ধীরে ধীরে কিডন্যাপারের সাথে মানবিকভাবে সখ্য হয়ে ওঠে। একটা সময় সে স্বীকারই করে না যে, তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল। কিন্তু আসলেও কি তাই? যদি তাই হয়, তাহলে এ ক্ষেত্রে আমাদের পক্ষ থেকে জবাব কে দেবে। দেখুন, পাশ্চাত্যের মানবাধিকার সংস্থাগুলো নারীদের অধিকারের পক্ষে কথা বলে। এমনকি দেখবেন পাশ্চাত্যের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বোরকা বা হিজাব নিষিদ্ধ করা হলে তারাও এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়ে নিন্দা জানায়। কারণ, তাদের মৌলিক বিশ্বাস হলো নিজ পছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরতে পারাটা একজন মানুষের মৌলিক অধিকার। যখন কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠান সেই অধিকারে হস্তক্ষেপ করে, তখন মূলত তার মৌলিক অধিকারের ওপরেই হস্তক্ষেপ চালানো হয়। তাই তারা মনে করে, একজন মেয়ে যেমন বিকিনি পরে নিজেকে প্রদর্শন করতে পারে তদ্রুপ একজন মেয়ে চাইলে বোরকাও পরতে পারে। এখানে কারও হস্তক্ষেপ মানেই হচ্ছে কারও ব্যক্তিগত অধিকারকে ক্ষুন্ন করা। অবশ্য এখানে বড়সর এক ‘কিন্তু’ আছে। যে ‘কিন্তু’ নিয়ে কথা না বললে আমার মূল বার্তা (message) আপনাদের কাছে স্পষ্ট করতে পারব না। পাশ্চাত্যের এই মানবাধিকার সংগঠনগুলো মূলত নারীদের পোশাকের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হলেও তাদের মূল বিশ্বাস হলো বোরকা বা আবায়া যে পোশাক একজন নারীর পুরো শরীর ঢেকে দেয়, তা নারীদের মূল পোশাক হতে পারে না। কারণ, কোনো নারীর পক্ষেই এ রকম পোশাক নিজের জন্য পছন্দ করা সম্ভব নয়, যা সেই নারীর সৌন্দর্যকে প্রকাশ হতে দেয় না। এটাই পাশ্চাত্যের ভোগবাদী ও বস্তুবাদী বিশ্বাস।

তারা বুঝেই উঠতে পারে না, একজন নারী যে তার শরীরের অঙ্গ দেখিয়ে সমাজে তার কদর বাড়াবে, সেই নারীই কেন তার সেই সব সুন্দর অঙ্গ ঢাকতে চাইবে! অর্থাৎ তারা মুসলিম নারীদেরকে তাদের বিশ্বাসের মাপকাঠি দিয়ে দাঁড়িপাল্লায় মাপে। তারা যেহেতু বস্তুবাদী বুঝ থেকেই এটাই বোঝে, একজন নারী যতভাবে তার শরীরের ভাঁজ মানুষের সামনে তুলে ধরবে, তত সে সম্মানিত হবে, সেখানে মুসলিম নারীদের বোরকার মতো পুরো শরীর ঢেকে রাখা পোশাক নিজ থেকে পছন্দ করা কী করে সম্ভব হতে পারে?

তাদের মতে এটা অবশ্যই সম্ভব নয়। যদি সম্ভব হয়েও থাকে তাহলে সেই নারী নিজ ইচ্ছায় পরেননি। তিনি হয়তো বা তার বাবা, ভাই অথবা পরিবারের ভয়ে পরছেন কিংবা খোদ সমাজই তার দিকে চোখ রাঙিয়ে এই পোশাক পরতে বাধ্য করছে। আর যদি তা নাও হয় অর্থাৎ নারী একেবারে নিজ থেকেই এই পোশাক স্বেচ্ছায় পরছেন, তাহলে সে ক্ষেত্রে সেই নারী আধুনিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। এখন এই নারীদেরকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা সম্ভব হলে তারা একসময় এই ‘অন্ধকার পোশাক’ (তাদের ভাষায়) ছেড়ে আসবে। তাই, তাদের জন্য আধুনিক শিক্ষা সহজ করতে পারলে অন্যান্য সব উদ্দেশ্যও ধীরে ধীরে সফল হবে। মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে যুক্তরাষ্ট্রের এ রকম এক মানবাধিকার সংগঠন American Humanists Association ম্যাসাচুসেটসের কলেজে বোরকা নিষিদ্ধ করা হলে নিন্দা জানিয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে প্রেস রিলিজ করে। মুখ ঢেকে যায় এমন যেকোনো পোশাককে কলেজ থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। সে হিসেবে বোরকাও নিষিদ্ধের তালিকায় চলে আসে। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই মানবাধিকার সংগঠনটি কলেজের এ ধরনের সিদ্ধান্তের নিন্দা জানায়। আপনিও হয়তো বা এ পর্যন্ত শুনেই খুশি হয়ে উঠবেন, একটি শক্তিশালী সেক্যুলার মানবাধিকার সংগঠনও মুসলিমদের পক্ষে আছে! বিষয়টি কতই না মধুর! তাহলে তো আমাদের অধিকারের বিষয়টি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে! না, বিষয়টি মোটেও এমন নয়। যদি আপনি পুরো বিবৃতিটি পড়েন, তবে বুঝতে পারবেন তারা বোরকাকে আসলে কোন চোখে দেখে। এই সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক রয় স্পেকহার্ডট (Roy Speckhardt) বলে,

বোরকা নারী পরাধীনতার এক শোচনীয় প্রতীক। আমাদের উচিত ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল মুসলিমদের সাথে এর ব্যবহার কমানোর জন্য একত্রে কাজ করা। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, তাদের এই অধিকারকে স্বাধীন রাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করতে হবে। এ রকম সিদ্ধান্ত ধর্মীয় টার্গেটিং নির্দেশ করে। ধর্মীয় অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হোক বা না হোক, এ রকম বিধিনিষেধ স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ এবং এগুলো সন্ত্রাসী হামলা ঠেকানোর জন্যও কোনো উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নয়।[1]

অর্থাৎ বিষয়টা একটু বিবেচনাতে নিন। সেই সংগঠনকে আপনি আপনার পাশে পেয়ে খুশি হয়ে উঠেছিলেন, সেই সংগঠন আপনার ধর্মীয় বা দ্বীনি পোশাককে কি হীন দৃষ্টিতেই না দেখে! এই বিবৃতির মাধ্যমে সে যেন কলেজ কর্তৃপক্ষকে জানান দিচ্ছে, আপনি যে পরিকল্পনায় এগোচ্ছেন সেটা সঠিক পরিকল্পনা নয়। মুসলিম নারীরা বোরকা পরা থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিক এটা আমরাও চাই, কিন্তু তা আইন করে নিষিদ্ধ করে সম্ভব নয়। এ জন্য আমাদেরকে মডারেট ও সেক্যুলার ‘মুসলিমদের’ সাথে মিলে কাজ করতে হবে, যারা তার সম্প্রদায়কে (community) বোঝাতে সক্ষম হবে যে, বোরকা মুসলিমদের জন্য আদৌ কোনো জরুরি পোশাক নয়। এখানে আপনারা একটা কথা বলতে পারেন, বুঝলাম এই মানবাধিকার সংগঠনটি চায় না মুসলিম নারীরা বোরকা পরুক। কিন্তু তাই বলে তারা একে পরাধীনতার শোচনীয় প্রতীক কেন বলল? আমি প্রথম দিকে যে আলোচনা করেছিলাম, সেখানে কিছু সময়ের জন্য আবার ফিরে যান। অর্থাৎ, বোরকাকে কোনো নারী স্বাধীনভাবে নিজের জন্য পছন্দ করতে পারেন, এই ধারণাতেই তারা বিশ্বাসী নয়। একজন নারী যত শিক্ষিতই হোন, এরপরও তিনি বোরকা পরেন মানে হলো তিনি নিজ থেকে এটি পরেননি। তিনি কোনো-না-কোনো ব্যক্তির চাপে পরতে বাধ্য হয়েছেন। এখন আপনি যদি ব্যক্তি বা সমাজপ্রভাব অস্বীকার করে বলেন, আল্লাহর ভয়ে আপনি পোশাক পরছেন, তবুও তারা একে পরাধীনতার পোশাকই সাব্যস্ত করবে। কারণ, আপনি কারও-না-কারও ভয়ে তো পরছেনই, মানুষ হোক আর আল্লাহই হোন। অর্থাৎ পাশ্চাত্যের দৃষ্টিতে খোদ বোরকাই পরাধীনতার প্রতীক, যা নারীরা স্বেচ্ছায় নিজের জন্য পছন্দ করতে পারে না। যে করে, হয় সে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠেনি আর নয়তো সে নিজেই পরাধীন কোনো ব্যক্তি, যে কিনা নিজের জন্য পরাধীন থাকাকেই পছন্দ করে নিয়েছে।

একইভাবে ২০১২ সালে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যানস রাইটস ওয়াচ (Human Rights Watch) তাদের ওয়েবসাইটে একটি আর্টিকেল প্রকাশ করে। যার শিরোনাম Banning Muslim Veil Denies Women a Choice, Too। এই প্রবন্ধের লেখক হলেন হিউম্যানস রাইটস ওয়াচের ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া বিভাগের সহকারী পরিচালক জুডিথ সান্ডারল্যান্ড (Judith Sunderland)। এই আর্টিকেলের প্রথম দিকে আপনার মনে হবে যে, বিশ্বে বিভিন্ন রাষ্ট্র কর্তৃক বোরকা নিষিদ্ধের যে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, হিউম্যানস রাইটস ওয়াচ (HRW) সেটাকে নারী স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ মনে করে। একইভাবে জুডিথ দাঁড়িপাল্লা ঠিক রাখার জন্য কোনো মুসলিম সংগঠন কর্তৃক নারীদের খোলামেলা পোশাকের ওপর হস্তক্ষেপেরও নিন্দা প্রকাশ করেন। মূল নিক্তি কিন্তু তার সেই মানবসৃষ্ট ‘মানবাধিকার’। অর্থাৎ তার এই নিক্তিতে বোরকার ওপর নিষিদ্ধকরণের যেমন সমালোচনা করতে হবে, তদ্রুপ কোনো মুসলিম সংগঠন নারীদের খোলামেলা পোশাকের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করলে, তারও সমালোচনা করতে হবে। অর্থাৎ জুডিথ বুঝাতে চাচ্ছেন তার নিক্তিই আদর্শ নিক্তি। এই নিক্তি মানতে খোদ মুসলিমরাও বাধ্য। যদিও মুসলিমরা তার কাছ থেকে মানবাধিকার শিখতে বাধ্য নয়। যুক্তির স্বার্থে ধরে নিলাম, জুডিথের কথাই সঠিক অর্থাৎ বোরকা নিষিদ্ধকরণের সমালোচনা করলে একইভাবে খোলামেলা পোশাক নিষিদ্ধের সমালোচনাও করতে হবে। কিন্তু জুডিথ কি তার আর্টিকেলজুড়ে এই আদর্শ বজায় রাখতে পেরেছেন? সহজ উত্তর হলো, না। আর্টিকেলের মাঝে এসে তিনি জানান,

মুসলিম সম্প্রদায়ের ভেতর ও বাইরে থেকে যেসব নারী অধিকার কর্মীরা নারী অধিকার নিয়ে কাজ করছেন, তারা দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তি দিয়ে আসছেন যে পর্দা করা, বিশেষ করে মুখ ও শরীরের সম্পূর্ণ পর্দা নারীর নিপীড়ন ও পরাধীনতার একটি শক্তিশালী প্রতীক।

এখানে থেমে গেলেও হতো, কিন্তু তিনি সম্পূর্ণ অপ্রাসাঙ্গিকভাবে বোরকাকে তালেবানদের পোশাক অভিহিত করেন। সাথে এও স্মরণ করিয়ে দেন আফগানিস্তানে নারীস্বাধীনতা লঙ্ঘিত হয়। সেখানে নারীদের সর্বনিম্ন গড় আয়ু এবং সর্বোচ্চ মাতৃমৃত্যু হার বিদ্যমান। অর্থাৎ HRW বিষয়টাকে এমনভাবে তুলে ধরতে চাচ্ছে যে, বোরকা পরার সাথে মাতৃমৃত্যু এবং সর্বনিম্ন গড় আয়ু উভয়ই সম্পর্কিত। অর্থাৎ বোরকা কখনো উন্নতির প্রতীক হতে পারে না। এটা পরাধীনতার প্রতীক। ২০১২ সালে সৌদি আরবেও বোরকা পরা বাধ্যতামূলক ছিল, কিন্তু জুডিথ চালাকি করেই উন্নত দেশগুলোর প্রসঙ্গ এখানে আনেননি, যেখানে মুসলিম নারীদের গড় আয়ুর পাশাপাশি অন্যান্য আধুনিক অধিকার এবং সুযোগসুবিধাও বিদ্যমান। আর ২০১২ সালে যে আফগানিস্তানের মতো গরিব দেশে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর আক্রমণ ও দখলদারিত্ব বিদ্যমান ছিল, তা তিনি কীভাবে এড়িয়ে যেতে পারলেন! তিনি সবকিছু এড়িয়ে গিয়ে নারীর পরাধীনতা, নারীর সর্বনিম্ন গড় আয়ু, মাতৃমৃত্যু সবকিছুকে যেন তিনি বোরকার ওপরই চাপিয়ে দিলেন।[2]

পাশ্চাত্যের সবচেয়ে বিশুদ্ধবাদী মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অবস্থাই যদি এমন হয়, তবে তো অন্যদের কথা বাদই থাকা উচিত। বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বোরকা নিষিদ্ধ করা হলে বা কোনো মেয়েকে শ্রেণিকক্ষ থেকে বের করে দেয়া হলে এখানকার মানবাধিকার ও নারী অধিকার নিয়ে কাজ করছে এমন সংগঠনগুলো কেন সরব হয়ে উঠে না, এর জবাব আশা করি আপনারা পেয়ে গেছেন। পরাধীনতার যে প্রতীককে কৌশলে তারা হটাতে চাচ্ছে, সেই প্রতীক যদি রাষ্ট্র বা কর্তৃপক্ষ নিজেই আইন করে নিষিদ্ধ করে দেয়, তবে তো তাদের উদ্দেশ্যই সফল হচ্ছে।

এখন মূল আলোচনায় আসি। আশা করি আমার এই আলোচনা অল্পতে শেষ করতে পারব। আমার আগের আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল একটি ব্যকগ্রাউন্ড তৈরি করা, যেন পাঠক বুঝতে পারেন আমি আসলে কী বোঝাতে চাচ্ছি। বোরকা পরাধীনতার প্রতীক। এই আখ্যান (narration) ভাঙার মূল দায়িত্ব আসলে কার? কারণ, ইঙ্গিত কিন্তু আমাদের দিকে তোলা হচ্ছে যে আমাদের ভয়েই (পুরুষদের ভয়ে) নারীরা বোরকা পরছে। অর্থাৎ আমরা আমাদের নারীদের ওপর জোর করছি, যে কারণে নারীরা বোরকা পরছে আর নয়তো নারীরা বোরকা পরত না। এখন পুরুষ হয়ে আমি যদি দাবি করি, না, আমি আমার ঘরের মেয়েদের ওপর বোরকা চাপিয়ে দিইনি। তারা নিজেরাই পরছে। এটা কৌশলগতভাবে শক্তিশালী হবে, না কি আমাদের নারীরাই যদি বলে উঠে বোরকা আমরা স্বেচ্ছায় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, তাঁর ফরয বা আবশ্যক বিধান পালনের জন্য পরছি—সেটা শক্তিশালী হবে? আশা করি এটিই তুলনামূলক শক্তিশালী কৌশল হিসেবে উঠে আসবে। কারণ, সবক্ষেত্রে নারীবাদীরা তাদের মতাদর্শ জোর করে ঢুকিয়ে দেয়ার জন্য আমাদের মুসলিম নারীদেরকেই বলির পাঠা (victim) বানাচ্ছে এবং মুসলিম নারীরা যে পুরুষদের মাঝে বসবাস করে অর্থাৎ তার বাবা, ভাই অথবা স্বামী এদেরকে কিডন্যাপার সাব্যস্ত করছে। এর ফলাফলস্বরূপ একসময়ে আমাদের স্বাধীন নারীরাও নিজদেরকে স্বাধীন ভাবতে পারেন না। তাঁরা মনে করেন অধীন না-থাকাটাই হচ্ছে মূল স্বাধীনতা। সমাজের পুরুষেরা যা বলবে, তার বিপরীত চলতে পারাটাই বুঝি আসল স্বাধীনতা। এখন যাকে ক্ষতিগ্রস্ত (victim) বানানো হচ্ছে, তিনি নিজেই যদি জানান দেন তিনি ভিক্টিম নন। বরং রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের সব সুবিধাভোগী একজন স্বাধীন নারী। তাকে কেউ যুলম করছে না বরং তিনি নিজ থেকেই সবকিছু করছেন, তাহলে নারীবাদ ও নারীবাদীদের সব ব্যাখ্যা ও টীকাটিপ্পনি মুহূর্তেই ভেঙে যেতে বাধ্য। কিন্তু আমাদের শিক্ষিত নারীদের কজনই বা এই জবাবটা দিচ্ছেন? শিক্ষিত নারীবাদীরা ধারবাহিকভাবে তাদের বক্রচিন্তা আমাদের সমাজে প্রবেশ করাচ্ছে। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে নারী হয়ে উঠার আগেই তাদের মস্তিষ্ককে কূটচিন্তায় প্রভাবিত করে তুলছে। সেখানে আমরা কীই বা করতে পারছি!

নারীবাদীরা তাদের অ্যাক্টিভিজমের জন্য অসংখ্য উপায় অবলম্বন করতে পারে। তারা নাটক বানাতে পারে, তারা কার্টুন বানাতে পারে। তারা লাখ লাখ ডলারের ডোনেশন দিয়ে সিসিমপুরের মতো প্রোগ্রাম করে নারীবাদ গেলাতে পারে। মিনা কার্টুনের মাধ্যমে বর্ণমালা শেখার আগেই আমাদের শিশুদেরকে নারীবাদের দীক্ষা দেয়া হয়। অর্থাৎ আধুনিক নারীবাদ  যেন এক দানব। এটা সত্য যে, এই দানবের বিরুদ্ধে আমরা ঠিক দানব হয়ে উঠতে পারব না। আমরা চাইলেই নাটক, সিনেমা বানিয়ে নারীবাদকে পালটা আক্রমণ করতে পারব না। এগুলো আমাদের জন্য বৈধ কোনো পথই নয়। কিন্তু যে পথগুলো বৈধ, সেই পথগুলোই আমরা কতটুকু ব্যবহার করতে পারছি? আমাদের শিক্ষিত নারীদের কজনই বা নারীবাদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করছেন? এই প্রশ্ন উঠে আসা অনেকখানি প্রাসঙ্গিক। যে নারীবাদীরা আমাদেরকে কিডন্যাপার সাব্যস্ত করছে, সেখানে বারবার আমাদের জবাবদিহিতামূলক লেখা আর এর পাশে আপনাদের নীরবতা কতটুকুই বা কার্যকর হবে। আপনাদের আধুনিক শিক্ষার কোনো অংশই কি তাহলে নারীবাদ ও নারীবাদীদের বিরুদ্ধে কাজে লাগাবেন না? আধুনিক শিক্ষা কি তাহলে পুরোটাই দুনিয়ার জন্য অর্জিত হয়েছে?

আপনাদেরকে ব্যবহার করে সমাজের পুরুষদের ওপর একের পর এক আক্রমণ আসছে। নতুন নতুন ও অবান্তর সব পরিভাষা ব্যবহার করে আপনাদেরকেই ভিক্টিম বানানো হচ্ছে। আর পুরুষদেরকে বানানো হচ্ছে শোষক। এখন শোষক কীভাবে জানান দেবে সে শোষক নয়? বরং যাকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষকে শোষক বানানো হলো এখানে তারও তো কিছু দায়িত্ব থাকে বলার যে, আমি শোষিত হইনি। বরং শোষণের যে পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, সেটাই অবান্তর। বৈবাহিক ধর্ষণের (Marital rape) ইস্যুটাই সামনে আনি। এখানে একজন পুরুষকে কেন্দ্র করে অভিযোগ আনা হচ্ছে যে, পুরুষ যখন তার স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া মিলিত হবে, তখন তাকে ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ সাব্যস্ত করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, একজন পুরুষ যতই বলুক এ জিনিস ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ নয়, সেই কথার জোর আপনি কতটুকু বর্ধন করতে পারবেন? কারণ, এখানে নারীর মনস্তত্ত্বকে আক্রমণ করে পুরুষের দিকে অভিযোগ টানা হয়েছে। অর্থাৎ একজন নারীকেই প্রথমে বুঝতে হবে, এই ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ নামক পরিভাষাটাই (term) অবান্তর। এর অস্তিত্ব কোনো কালেই কোন সমাজে ছিল না। এমনকি consent  (পারস্পরিক সম্মতি) নামক যে পরিভাষার উদ্ভব ঘটানো হয়েছে, সেই পরিভাষা মেনে নিলে বিবাহবহির্ভূত মিলনকেও বৈধতা দিতে হবে। এমনকি পুরুষে পুরুষে মিলনের বৈধতাও উঠে আসবে। অর্থাৎ সেক্যুলার consent পরিভাষাকে গ্রহণ করে নিলে বৈবাহিক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা দৈহিক সম্পর্ককে যেমন প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়, ঠিক একইভাবে বিবাহবহির্ভূত দৈহিক সম্পর্ককে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই মেনে নেয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমরা যাঁর দেখানো পথে বিয়ের মতো সম্পর্ক গড়ি অর্থাৎ আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেখানো পথে, তাঁর অভিধানে আদৌ কি এ ধরনের পরিভাষা ছিল, যা তিনি তাঁর পবিত্র সাহাবিদের বলে গেছেন? মূল কথা হচ্ছে, একজন পুরুষকে যেমন নারীবাদের বিরুদ্ধে লড়ে যেতে হচ্ছে যে, সে শোষক নয়, যালিমও নয়, ঠিক একইভাবে আমাদের শিক্ষিত নারীদেরকেও শরয়ি সীমায় থেকে কার্যক্রম বা লেখালেখিতে সামনে আসা উচিত। তাঁরা সমাজের পুরুষদের পক্ষে বলবেন। নারী-পুরুষের পারস্পরিক ইনসাফভিত্তিক সম্পর্ক ও অবস্থানের বিষয়টি তুলে ধরবেন। মূলত সমাজের পুরুষেরাই তো কোন-না-কোনো নারীর বাবা, ভাই আর নয়তো তার স্বামী। অর্থাৎ যাদের মাঝে আপনি একান্তভাবে বেড়ে উঠেছেন। ভারসাম্যপূর্ণ সমাজব্যবস্থায় নারীবাদ কেবল দ্বীন ইসলামের জন্যই নয়, এটা যেকোনো ধর্ম ও রুচিসম্পন্ন সমাজ এবং সম্প্রদায়ের জন্যও হুমকি। আমাদের নারীরা প্রস্তুত তো?

____

[ এস এম সাওয়াবুল্লাহ্‌ হক, দায়ি ও অনলাইন এক্টিভিস্ট

বিদ্যুৎ প্রকৌশলী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ]

[1] https://americanhumanist.org/press-releases/2010-01-humanists-condemn-massachusetts-college-burqa-ban/

[2] https://www.hrw.org/news/2012/09/23/banning-muslim-veil-denies-women-choice-too

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *