এস এম সাওয়াবুল্লাহ্ হক
একজন সেক্যুলার কমরেডের ফেইসবুক টাইমলাইনে যদি কখনো যান, তাহলে দেখবেন সে তার আদর্শকে খুব নিখুঁতভাবে বাংলাদেশের মুসলিমদের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক পরিচয় (আইডেন্টিটি) থেকে রক্ষা করে চলেছে। তাকে এ রকম কোন ভিডিয়ো শেয়ার দিতে দেখবেন না, যা মুসলিমদের সংস্কৃতির ছোট থেকে ছোট অংশ প্রকাশ বা প্রচার করছে। কোনো বাচ্চার গজল বা তিলাওয়াত ভাইরাল হলে আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি কোনো সেক্যুলার কমরেডকে দেখবেন না সেই ভাইরাল জিনিস এই বলে শেয়ার দিচ্ছে যে, বাচ্চাটার গলা খুব সুন্দর। বা বাচ্চার কন্ঠে মাদকতা রয়েছে। এ রকম কোনো কাহিনি লিখে কখনোই এদেরকে এগুলো শেয়ার দিতে দেখবেন না।
কিন্ত কেন? আসলে একজন সেক্যুলার মনে করে জাগতিক জীবনে এগুলো সবই অকার্যকর ও অনর্থক। আধুনিক দুনিয়াতে এগুলোর কোনো প্রয়োজন নেই। বরং যে সব বাবা-মা তার সন্তানদের দিয়ে এসব কাজ করাচ্ছে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার যে, কেন তারা তাদের সন্তানদের সবচেয়ে মূল্যবান সময়কে (মোস্ট প্রেশাস টাইম) মূল্যহীন কাজের পেছনে ব্যয় করাচ্ছে। এ জন্য এদেরকে মাদরাসার শিশুদের ব্যাপারে আফসোস করতে দেখবেন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে দেখবেন এতগুলো শিশুর গন্তব্যই বা কী!
তাদের এই দীর্ঘশ্বাস আসে তাদের আগ্রাসী সাংস্কৃতিক চিন্তা থেকে। আমি আপনাদেরকে একটি প্রকাশ্য ও স্পষ্ট উদাহরণ দেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার প্রফেসর কামরুল হাসান মামুন দেখবেন শিক্ষকতার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও শিক্ষা কাঠামো নিয়ে তার খুব চিন্তা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এত কষ্ট করে হলে থাকে, সেটা নিয়ে তার আফসোসের কোনো অন্ত নেই। আমিও বলি, আফসোসের স্থানে আফসোস তো করতেই হবে। কিন্ত এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেপেলেই সামান্য ইফতারির প্রোগ্রাম করতে গিয়ে ছাত্রলীগের হাতে মার খেয়ে অসহায় হয়ে থাকলেও এ নিয়ে তার কোনো কথা পাবেন না। সে একই ছাত্র, সে একই বিশ্ববিদ্যালয়, কিন্ত মার খাওয়ার পেছনে যেহেতু সেক্যুলার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না , তাই এটা নিয়ে আদৌ কোনো কথা বলার প্রয়োজন নেই। মনে মনে, বাবা ছাত্রলীগ তোমরা আছ বলেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কুযুক্তি আর অন্যায় আবদারের চর্চাকেন্দ্র বানাতে পারছি। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি আপনি আপনার সাংস্কৃতিক আদর্শকে নিয়ে ততক্ষণ পর্যন্ত প্রভাব রাখতে পারবেন না, যদি না আপনি আপনার নিজের সংস্কৃতি এবং বামদের সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য করতে না-পারেন।
দেখুন, জমিদারেরা চায় তার প্রজারা জমিদারদের সংস্কৃতি লালন করুক। তারা চায় তার প্রজারা হুবুহু তার মতো কিছু করতে না পারলেও অন্তত একটা গরিবি সংস্করণ (ভার্শন) তৈরি করে সেটা নিয়েই থাকুক। বাংলার হিন্দু জমিদারেরা মুসলিমদের দাঁড়ি পছন্দ করত না। মুসলিমরা যেন দাঁড়ি রাখার ব্যাপারে অনুৎসাহী হয়, এ জন্য এর ওপর কর বসাত। গরু জবাই পছন্দ করত না। এ জন্য মুসলিমদের ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয়া হতো। এই হলো সাংস্কৃতিক আগ্রাসন অর্থাৎ সে যা পছন্দ করবে আপনাকেও তা-ই পছন্দ করতে হবে অথবা সে যা নিষেধ করবে বা সে যা অপছন্দ করবে, আপনাকেও সেটা থেকে বিরত থাকতে হবে। আপনি তার কথা শুনতে বাধ্য।
সেই একই স্বভাব (ন্যাচার) বা আচরণ বর্তমান সময়ের কমরেড সেক্যুলাররাও লালন করে। তাদের নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী নেই এটা সত্য কিন্ত সেক্যুলার রাষ্ট্রযন্ত্রের যে বাহিনী আছে, সে বাহিনী তাদের হয়ে কাজ করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। এ ছাড়া পত্রিকা, মিডিয়া এবং কিছু মুখরোচক শব্দ তো আছেই যেই শব্দের জোরে তাদের আদর্শকে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। আর নিজেরা এমন এক ঢং করে, যেন সে যে রাষ্ট্রে আছে অথবা যে প্রতিষ্ঠানে আছে সেখানে কোনো মুসলিমই নেই। মুসলিম সংস্কৃতি তো দূরের কথা, এখানে মুসলিমদের অনুভূতির কোনো মূল্যই নেই। মুসলিমদের সংস্কৃতিই যেন মূল আগাছা।
অন্যদিকে আমরা সাধারণ মুসলিমেরা কী করছি? ফেইসবুকে কোনো বক্তার গান হারাম হওয়ার ওয়াজ শেয়ার দিই ঠিকই, আবার সপ্তাহ খানিকের মাঝেই অ্যাকোস্টিক গিটারে খালি গলায় কোলকাতার কোনো শিল্পী গান গেলে তাও শেয়ার দিই।
নিজ বাচ্চার কুরআন তিলাওয়াত শেয়ার দিই, আবার কোনো স্কুলের শিক্ষক তার ছাত্রীদের দিয়ে পুতুল নাচ দেয়ালে তাও শেয়ার দিই। আমাদের আদর্শিক মর্যাদা (প্রাইড) কীভাবে দাঁড়াবে, যদি আমরা ঝালমুড়ির মতো আচরণ করি! আপনি যখন সেক্যুলার সংস্কৃতির কোনো কিছু প্রচার করেন, তখন এই সেক্যুলারদের সাংস্কৃতিক গর্বকে আরও উঁচুতে নিয়ে যান। তারা গর্ববোধ করে। মাদরাসার ছাত্রদের ওপর তাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন খাটানো গেল না বলে তারা হতাশা অনুভব করলেও এই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যদের আচরণ তাদেরকে আবারও মূল জায়গায় ফিরিয়ে আনে। তারা বুঝতে পারে আমাদের হাতে থাকা রশিটা এই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের নাকে এখনো বাঁধা রয়েছে। যতক্ষণ আছে ততক্ষণ এরাই আমার গোলাম। এই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা যতদিন পর্যন্ত নিজের পরিচয় (আইডেন্টিটি) সেক্যুলারদের থেকে আলাদা করতে না পারছে, ততদিন পর্যন্ত মুক্তি নেই।
আপনি বলেন, হায়রে নব্বই শতাংশ মুসলিমের দেশে ইফতারি করলেও এমন! আপনি এ ক্ষেত্রে হয়তো বা বুঝেছেন যে, আপনার ইফতারিতেও সেক্যুলারদের জ্বালাপোড়া হয়। আবার সেই আপনি বুঝেন না যে, আপনার ছেলেকে একুশে ফেব্রুয়ারির কথিত প্রভাতফেরিতে পাঠানো হলে সেই সেক্যুলারদেরকেই আপনি গর্বিত করেন। আপনার বাচ্চার জন্মদিন পালন করে আপনি তাদেরকে জানান দেন যে আপনি এখনো আধুনিক আছেন। আপনার শেকড়ে আপনি ফিরে জাননি। আপনি পহেলা বৈশাখ পালন করে জানান দেন আপনি শেকড়ে গিয়েছেন, তবে তা সেক্যুলারদের বানানো কৃত্তিম শেকড়ে। আপনার অনুভূতি মুসলিম সংস্কৃতির সাথে নেই। থাকলেও পরক্ষণেই জমিদারের সন্তষ্টির জন্য চলে যান ‘কর্তা যা ভালোবাসে, তা-ই আমি করি’ এই সংস্কৃতিতে। তাহলে আমাদের দিয়ে হবেটা কী বলেন? চলেছি সারাজীবন মূর্খ হয়ে। ছিলাম দাস, বুঝিইনি। আপনি ভেবে নিয়েছেন আমি তো আদরের সন্তান, কিন্ত এখন দেখেন দাসেরাও অনেক সময় হয়ে ওঠে সন্তানের মতো। এখন আপনার নিজ সন্তানের নাকেও সেই রশি পরিয়ে দিচ্ছেন যার আরেক প্রান্ত অনেক আগে থেকেই কালচারাল জমিদার এলিটদের হাত দিয়ে ধরা।