প্রচলিত ভুল : অনির্দিষ্ট ও নির্দিষ্ট তাকফিরের মাঝে পার্থক্য না-করা

শাইখ আসিম আল-বারকাওয়ি (হাফিযাহুল্লাহ)

ইলমের ময়দানের প্রাথমিক স্তরের অনেক তালিবুল ইলম উলামা কিরামের বইয়ে তাঁদের সাধারণ কথাবার্তাগুলোয় পার্থক্য করতে পারে না। যেমন, ইমাম ইবনুল কাইয়িম পাঁচশত ইমাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তাঁরা ওই লোকদের তাকফির করেন, যারা আল্লাহর আরশের ওপর সমুন্নত হওয়াকে অস্বীকার করে এবং ইসতিওয়াকে (সমুন্নত হওয়া) ইসতিলা (ক্ষমতাগ্রহণ) অর্থে প্রয়োগ করে। ইমামদের এসব কথাও রয়েছে, ‘যে বলে কুরআন মাখলুক সে কাফির হয়ে যাবে’, অথবা ‘যে বলে আল্লাহ সব জায়গায় আছেন, সেও কাফির হয়ে যাবে।’ যারা কুফরি কাজ ও কথাবার্তায় লিপ্ত হয়, আমরা তাদের ব্যাপারে যে সাধারণ কথাবার্তা বলি এ ব্যাপারটাও তেমনই। যেমন, ‘অমুকে কুফরি কাজে লিপ্ত হয়েছে’ অথবা ‘সে কুফরি কথা বলেছে, কুফরি কাজ করেছে।’ ফলে প্রাথমিক স্তরের কিছু লোক এ ধরনের সাধারণ কথাবার্তার কারণে আমাদের অপবাদ দিয়ে থাকে, আমরা নাকি নির্দিষ্টভাবে তাকফির করি। অথচ আমরা সেটা বলিইনি, বা বলার ইচ্ছাও করিনি।

একইভাবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর পথ থেকে বিচ্যুত বিভিন্ন দলের ব্যাপারে উলামা কিরামের সাধারণ কথাবার্তাগুলোর ব্যাপারটাও তা-ই। যেমন, তাঁরা বলেন, ‘জাহমিয়ারা কাফির’ বা ‘কাদরিয়ারা কাফির’ প্রভৃতি কথাবার্তা। এ ক্ষেত্রে তারা (উগ্র তাকফিরি) এসব সাধারণ কথাবার্তা ও নির্দিষ্ট ব্যক্তির ওপর সেটা প্রয়োগের মাঝে পার্থক্য করে না। ফলে যাদের কাছ থেকেই এসব কথাবার্তা শুনতে পায় বা যাদের বইয়েই এগুলো পড়ে, উল্টো তাদেরকেই তাকফির করা শুরু করে। এমনকি কারও কারও ব্যাপারে তো এও শুনেছি, তারা অনেক বড় বড় ইমামদেরও আল্লাহর সিফাতের তাওয়িলের (দূরবর্তী ব্যাখ্যা) কারণে তাকফির করে। যেমন, হাফিয ইবনু হাজার, ইমাম নাওয়াবি প্রমুখ। এ ছাড়াও সাম্প্রতিককালে সাইয়িদ কুতুবসহ প্রমুখকে। এগুলো দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও তাড়াহুড়োপ্রবণতা। এর পরিণতি কখনোই প্রশংসনীয় নয়।

বিজ্ঞ উলামা কিরামের সঠিক নীতি হলো, তাঁরা যদিও এসব কথাবার্তার ব্যাপারে বা যারা এগুলো বলে তাদের ব্যাপারে এ ধরনের সাধারণ শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন, কিন্তু নির্দিষ্ট ব্যক্তির ক্ষেত্রে তাকফিরের শর্ত ও প্রতিবন্ধকতা দেখার পরই তাকফিরের বিধান প্রয়োগ করেন। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ তাঁর ফাতওয়াগ্রন্থে কয়েকবার উল্লেখ করেছেন,

‘সালাফ ও ইমামরা জাহমিয়াদের সাধারণভাবে তাকফির করে থাকেন। কিন্তু তাদের প্রতিজন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে কেবল তখনই তাকফির করতেন, যখন তার ওপর এমন প্রতিষ্ঠিত দলিল পাওয়া যেত, যার অস্বীকারকারীকে কাফির সাব্যস্ত করা হয়।’ [মাজমুয়ুল ফাতাওয়া : ২/২১৪]

সারসংক্ষেপ

  • সাধারণ তাকফিরের মানে হলো, কুফরের বিধানটা তার কারণের ওপর বর্তানো। কারণের কর্তা বা নির্দিষ্ট ব্যক্তির ওপর নয়।
  • আর নির্দিষ্ট তাকফিরের মানে কুফরের বিধান নির্দিষ্ট ব্যক্তির ওপর প্রয়োগ করা।

সারকথা, নির্দিষ্টভাবে তাকফির (মুয়াইয়ান তাকফির) ও সাধারণ তাকফিরের (মুতলাক তাকফির) প্রতি লক্ষ না-রাখাই পদস্খলন ও বিভ্রান্তির কারণ। কিছু লোক এর শিকার। ফলে তারা এমন অনেক লোককে তাকফির করেছে, যাদের সতর্ক ও দলিল প্রতিষ্ঠিত না-করে তাকফির করা বৈধই ছিল না। এর মাধ্যমে তারা নিজেরাও পথভ্রষ্ট হয়েছে, সেই সাথে বহু লোককেও পথভ্রষ্ট করেছে।

______________

[ সংগ্রহসূত্র : আর-রিসালাতুস সালাসিনিয়াহ ফিত-তাহযির মিনাল গুলু ফিত-তাকফির, মুখতাসার সংস্করণ ]

Leave a Reply