শাইখ আনওয়ার শাহ কাশ্মিরি
অনুবাদ : মুফতি সালমান মাসরুর
নিরীক্ষণ : উসতায শাইখুল ইসলাম
দুনিয়ার আকাশে আল্লাহর অবতরণ, আরশে সমুন্নত হওয়া ইত্যাদি মুতাশাবিহাতের[১] ক্ষেত্রে সালাফদের মাযহাব হলো, যেসব বিষয়ে প্রকাশ্য অর্থ নেয়া যায়, সেসব বিষয়ে কোনো তাওয়িল (দূরবর্তী ব্যাখ্যা) ও কাইফিয়াত (ধরন) বর্ণনা করা ছাড়া প্রকাশ্য অর্থের ওপর ইমান আনা এবং কাইফিয়াত (ধরন) আল্লাহর কাছে তাফউইদ (ন্যস্ত) করা।
কয়েকজন সালাফ যেমন ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর দিকে সম্পৃক্ত করে বলা হয়, তাঁরা কুরআনের মুকাত্তাআত (যেমন, আলিফ লাম মিম, কাফ, হা-মিম, সাদ) আয়াতগুলোর মূল অর্থ ও উদ্দেশ্য জানেন। যদি বিষয়টি সহিহও ধরা হয়, তবু এর উদ্দেশ্য হলো, সম্ভাব্য কিছু অর্থ ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করা। আমাদের মাযহাবের (হানাফি) নির্ভরযোগ্য একটি কিতাব ‘জামিয়ুল ফুসুলাইন’ থেকে ধারণা হয় যে, মুতাশাবিহাতের শাব্দিক অর্থ করাও নিষিদ্ধ। কিন্তু আমার মেধা বলে, নিষিদ্ধ তো মুতাশাবিহাতের তাফসির (ব্যাখ্যা) করা। মূলত শব্দের অধীনে যে অর্থ রয়েছে, এর অনুবাদ নিষিদ্ধ নয়। যেমন হাত, পা ইত্যাদি।
কালামশাস্ত্রবিদদের মাযহাব (মতাদর্শ) হলো, মুতাশাবিহাতের ক্ষেত্রে শরিয়াহমোতাবেক তাওয়িল করা।[২] কালামশাস্ত্রবিদরা আরও বলে—সালাফদের মাযহাব (পন্থা) সবচেয়ে বেশি নিরাপদ আর আমাদের মাযহাব সবচেয়ে বেশি হিকমাতপূর্ণ (প্রজ্ঞাময়)।[৩] তাদের এ কথার উদ্দেশ্য হলো, আহলুস সুন্নাহর মূল মাযহাব তাফউইদ, তবে বিশেষ প্রয়োজনে এবং আহলুস সুন্নাহবিরোধীদের প্রতিরোধে তাওয়িলের অবকাশ রয়েছে।[৪] কালামিরা ইসলামবিদ্বেষীদের সাথে তর্ক-বিতর্কের সময়ে তাওয়িলের মুখাপেক্ষী হয়েছিলেন। কিছু লোক তাদের ক্ষেত্রে যে কটু শব্দ ব্যবহার করেছেন, তা থেকে তারা মুক্ত।[৫]
মুতাশাবিহাতের ক্ষেত্রে বিদআতিদের মাযহাব (মতাদর্শ) হলো, তাদের সীমাবদ্ধ আকলমোতাবেক শরিয়াহবিরোধী তাওয়িল। নাউযুবিল্লাহ। মুশাব্বিহা[৬] সম্প্রদায়ের মাযহাব হলো, অন্যান্য দেহের মতো আল্লাহরও দেহ রয়েছে। আরও কিছু মাযহাব রয়েছে, আমি তা উল্লেখ করছি না।
সালাফদের তাফউইদ (সমর্পণ) দ্বারা কী উদ্দেশ্যে, তা দুটো অর্থের সম্ভাবনা রাখে :
১. বিষয়টি আল্লাহর কাছে তাফউইদ (ন্যস্ত) করা এবং যারা তাওয়িল করে যেভাবেই তাওয়িল করুক না কেন তাদের বিরোধিতা না-করা। কারণ, তারা স্বীকার করছে যে তাদের জ্ঞান নেই।
২. বিশ্লেষণ ও কাইফিয়াত (ধরন) আল্লাহর কাছে তাফউইদ (ন্যস্ত) করা এবং যারা নিজ রায় ও আকল দিয়ে তাওয়িল করে তাদের বিরোধিতা করা।
সম্ভাব্য দুটো অর্থের দ্বিতীয় অর্থই সালাফদের উদ্দেশ্য, প্রথমটি নয়।[৭]
__________
[ সংগ্রহসূত্র : ‘সুনানুত তিরমিযি’র ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘আল-আরফুশ শাজি : ১/৪১৬’ ]
টীকা :
[১] মুতাশাবিহাত অর্থ সাদৃশ্যপূর্ণ বা অস্পষ্ট। মূলত আল্লাহর সিফাত বা গুণাবলি মুতাশাবিহাত নয়। এগুলোর অর্থ স্পষ্ট, তবে এগুলো ধরনের দিক থেকে মুতাশাবিহাত বা অবোধগম্য। মুতাশাবিহাত হচ্ছে কুরআনের বিচ্ছিন্ন শব্দের আয়াত, যেগুলোকে মুকাত্তাআত বলা হয়। যেমন, আলিফ-লাম-মিম, কাফ ইত্যাদি। [অনুবাদক]
[২] আহলুস সুন্নাহর অবস্থান হলো, ‘কোনোকিছুই আল্লাহর মতো নয়’—এই মূলনীতি মেনে সিফাতের সুস্পষ্ট ও সুসাব্যস্ত অর্থগুলো মেনে নেয়া। তাঁরা নিজ থেকে এগুলোর ধরন-নির্ধারণ করেন না। এর জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর কাছে। সিফাতের কাইফিয়াত বা ধরন-নির্ধারণ করলেই তো সাদৃশ্য দেয়া হয়। তাই, সাদৃশ্যবাদ থেকে বাঁচতে তাকয়িফ থেকে বাঁচতে হবে। অর্থের তাওয়িল বা অপব্যাখ্যা করে নয়। আর সিফাত ছাড়া অন্যান্য নসেরর ক্ষেত্রে ‘শরিয়াহমোতাবেক তাওয়িলের’ অর্থ হলো, যতক্ষণ প্রকাশ্য ও হাকিকি অর্থগ্রহণ অসম্ভব না হবে, ততক্ষণ এর তাওয়িল, দূরবর্তী ব্যাখ্যা ও রূপক অর্থ নেয়া বৈধ নয়। এটিই সালাফদের নীতি ও স্বীকৃত উসুল। [নিরীক্ষক]
[৩] সালাফদের পন্থা সবচেয়ে নিরাপদ ঠিক। কিন্তু খালাফ অর্থাৎ পরবর্তী কালামবিদদের পন্থা বেশি জ্ঞানগর্ভ ও প্রজ্ঞাপূর্ণ—কথাটা একদমই ভুল। কারণ, তাদের পন্থা জ্ঞান ও প্রজ্ঞা পর্যন্ত পৌঁছে না, বরং ভ্রষ্টতা ও দিশাহীন অবস্থায় নিয়ে যায়। মূলত সালাফদের নিরাপদ পন্থাই অধিক জ্ঞানগর্ভ ও প্রজ্ঞাময়। তাঁরা তো ওইসব বিষয়ই ধারণ করেছিলেন, যা আল্লাহ ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে এসেছে। [নিরীক্ষক]
[৪] আহলুস সুন্নাহবিরোধীদের প্রতিরোধে তাওয়িলের কোনোই অবকাশ নেই। আল্লাহর সিফাতকে তাওয়িলের মাধ্যমে বিকৃত করে বিরোধীদের প্রতিরোধ করতে আমরা আদিষ্ট নই। এ জন্যই মুতাযিলাদের ফিতনার সময়ে হকপন্থী সালাফরা এদেরকে মানাতে তাওয়িলের দিকে ঝুঁকেননি, বরং চরমমাত্রার নির্যাতন সয়েও ইসবাতের ওপরই অটল ছিলেন। আর এটিই মূলত আহলুস সুন্নাহর বিশুদ্ধ পন্থা। [নিরীক্ষক]
[৫] ইসলামবিদ্বেষীদের সাথে তর্ক-বিতর্কের সময়ে তাওয়িলের মুখাপেক্ষী হওয়াটাকে ওজর হিসেবে গণ্য করা হবে, যদি না অন্তর থেকেই তাঁরা এমনটা করে থাকেন। কিন্তু তাওয়িলের প্রতি অন্তরের বিশ্বাস থেকেই যদি তারা এমন করে থাকেন, তাহলে এটা ওজর হবে না, বরং তা ভুল বলে গণ্য হবে। আর পরবর্তীদের জন্য তাদের ভুলটাকেই গ্রহণ করা অথবা তাদের ওজরটাকে নিজেদের আকিদাহ বানিয়ে নেয়া আরও মারাত্মক ভুল। এমন ভুল আকিদাহর ব্যাপারে উম্মাহকে সতর্ক করা এবং তাদের চিহ্নিত করে দেয়া মোটেও ভুল কাজ নয়, বরং এটিই সালাফদের মানহাজ। [নিরীক্ষক]
[৬] যারা তাশবিহ করে তারাই মুশাব্বিহা। তাশবিহ অর্থ তুলনাকরণ, সাদৃশ্য-নির্ধারণ। অর্থাৎ, আল্লাহর সিফাতকে সৃষ্টির সাথে তুলনা দেয়া বা সাদৃশ্য-নির্ধারণ করা। যেমন বলা, আল্লাহর হাত রয়েছে, যা সৃষ্টির হাতের মতো বা কেউ বলল, আল্লাহর হাত রয়েছে আমাদের হাতের মতো। এটা পথভ্রষ্টদের আকিদাহ। বিশুদ্ধ আকিদাহ হলো, আল্লাহর হাত রয়েছে তবে তা সৃষ্টির মতো কোনো অঙ্গ নয় এবং সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্যও নয়। আল্লাহ বলেন,
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيءٌ وَهٌوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ
‘কোনো কিছুই তাঁর মতো নয়। তিনি সব শুনেন, সব দেখেন।’ (সুরা আশ-শুরা, ৪২: ১১)
বরং হাত আল্লাহর একটি সিফাত (গুণ)। এর ধরন আমাদের অজানা, ধরন নিয়ে প্রশ্ন করাই বিদআহ এবং এর ওপর ইমান আনা আবশ্যক। [অনুবাদক]
[৭] অর্থাৎ সালাফদের মানহাজ হলো, তাঁরা সিফাতের অর্থ জানতেন, কিন্তু এগুলোর ধরন আল্লাহর কাছে ন্যস্ত করতেন। সিফাতের অর্থ তো জানা, তবে ধরন অজানা। আল্লাহর সিফাত কেমন আল্লাহই ভালো জানেন। সেই সাথে সিফাতের তাওয়িলে নিমজ্জিত না-হওয়া। যারা সিফাতের ক্ষেত্রে আকলের ব্যবহার করে তাদের প্রত্যাখ্যান করা। [অনুবাদক]