সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী সমাজ এবং আমাদের ব্যর্থতা

এস এম সাওয়াবুল্লাহ্ হক

বাংলাদেশে বর্তমানে যতগুলো সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী সমাজ (ইন্টেলেকচুয়াল সোসাইটি) রয়েছে, তার একটাও মুসলিমদের জন্য বিশেষভাবে কল্যাণকামী নয়। আমি-আপনি সাধারণ মুসলিম হিসেবে পাশের দেশের হিন্দুত্ববাদী চোখ রাঙানিকে আমাদের জন্য অস্তিত্বের হুমকির কারণ মনে করি। কিন্ত বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের এই চিন্তাকে ইন্টেলেকচুয়াল সোসাইটিগুলো বাতুলতা মনে করে মাত্র। তাদের বিশ্বাস পূর্ববঙ্গে মুসলিমরা কখনোই মুসলিম হিসেবে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়নি। দেশ যেখানে ভাগই হয়েছে হিন্দু-মুসলিম আলাদা করে, তাই তারা এটা মানতে নারাজ যে , মুসলিমরা নিজেদের দেশেই হুমকির সম্মুখীন হতে পারে। তারা দেশভাগের পর থেকে এই পর্যন্ত হিন্দু এবং উপজাতিদের অস্তিত্ব নিয়ে যতটা চিন্তিত, তার ছিটেফোটা চিন্তাও মুসলিমদের জন্য করেনি। অর্থাৎ তাদের মানসিক ধাঁচই (মেন্টাল শেইপ) এ রকম চিন্তার কারণ। তাই, বাংলাদেশে মুসলিমরা হঠাৎ করে কোনো নির্যাতন বা দাঙ্গার সম্মুখীন হলে এর দায় রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক ইত্যাদি কিন্ত তা ধর্মীয় কারণ হতে পারে বলে তারা কখনোই মনে করে না। এই জন্য মধুখালীর ঘটনাতে দুই মুসলিম শ্রমিক নিহত হওয়ার পর মুসলিমদের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়েছে বা হিন্দুরা পার্শ্ববর্তী দেশের হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা উৎসাহিত হয়ে মুসলিমদেরকে ষড়যন্ত্র করে পিটিয়ে মেরেছে, এগুলোর কোনটাই আপনি তাদেরকে মানাতে পারবেন না। কিংবা মুসলিমরা দাঙ্গায় পড়ে হিন্দুদের দ্বারা নিহত হয়েছে এই বাইনারি (Binary) তত্ত্বও তারা মানতে রাজি নয়। তাদের মস্তিষ্ক সবসময় এই বার্তাই দেয় যে, মুসলিমদেশে মুসলিমদের পক্ষে তাদের ধর্মের জন্য নির্যাতিত হওয়া সম্ভব নয়।

এ জন্য মধুখালীর ঘটনা নিয়ে দেখবেন না ইন্টেলেকচুয়াল সোসাইটিগুলোর কেউ আলোচনা করেছে। তারা আলোচনা করেনি, তার মানে হলো এটা সরকারের নজরে আসার মতোও বিষয় নয়। অর্থাৎ এ বিষয়টা এমনি এমনি ব্যাপার। মানবজমিনের রিপোর্ট পড়ে আপনি হয়তো বা বার্তা পাবেন যে দুই শ্রমিককে মারা হলো, এঁদের মারা হয়েছে ষড়যন্ত্র করে। এই ষড়যন্ত্র করে তো একজন হিন্দুকেও মারা যেত, কিন্ত এই মুসলিম শ্রমিককেই কেন মারা হলো? এই প্রশ্নের জবাব আসবে যে, তারা ওখানে কাজ করছিল আর তাদের কাছে চাঁদা চাওয়া হয়েছিল, যেহেতু তাঁরা চাঁদা দেয়নি, তাই ষড়যন্ত্র করে মেরে ফেলা হয়েছে। তারপর প্রশ্ন করবেন, তাহলে সেই ষড়যন্ত্রটা মূর্তি পুড়িয়ে করতে হলো কেন। তাদের মারলে তো এমনিতেই মারা যেত। মূর্তিতে আগুন দেয়ার কারণ দেখিয়ে পিটিয়ে মারা হলো কেন? আর চাঁদা দিতে না-পারার কারণে এই গ্রামে কি কখনো কাউকে এভাবে মারা হয়েছে, এ রকম কোনো রেকর্ড আছে? এখানেই দেখবেন কবি হয়ে যাবে নীরব। তারপরও তারা একে ধর্মীয় আগ্রাসনের হত্যা মানতে নারাজ।

এবার আসুন আমরা একটু উল্টোভাবে চিন্তা করি। ধরুন, মন্দিরে আগুন লেগেছে এটাই শেষ ঘটনা। এরপর আর কিচ্ছুই হয়নি। অর্থাৎ কোনো শ্রমিককে মারা হয়নি, ধরা হয়নি। অর্থাৎ কিছু হয়নি। এখন শুধু চিন্তা করে বলবেন যে, তখন তারা এই ঘটনাকে কী হিসেবে তুলে ধরত? অবশ্যই একে হিন্দুদের অস্তিত্বের হুমকি হিসেবেই চিহ্নিত করত। এর সাথে পত্রিকাগুলোর সম্পাদকীয়গুলোতে অসংখ্য লেখা বেরিয়ে আসত যে, কীভাবে হিন্দুদের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে।

অর্থাৎ এদের মেন্টাল শেইপই হয়েছে এভাবে যে, পূর্ববঙ্গে মুসলিমদের অস্তিত্ব যে হুমকির সম্মুখীন হতে পারে তা তারা মানতে রাজি নয়। এ জন্য এ রকম কোনো বিশৃঙ্খলার জন্য তারা হয়তো বা তদন্ত চেয়ে ফেইসবুকে ছোটখাটো কোনো লেখা দেবে কিন্ত আবেগের স্থান থেকে তারা  ঠিকই মুসলিমদেরকে নিয়ে ভাবতে নারাজ। জীবনের পুরোটাই বাম রাজনীতিতে কাটানোর জন্য এরা মনে করে বসেছে যে, পূর্ববঙ্গের মানুষ মানেই হলো ইসলাম ধর্মের বাইরে যারা আছে, তারা। তাদের অধিকারকে খর্ব করেই এই উপমহাদেশ দুভাগ করা হয়েছে। আহমদ ছফা কীভাবে বুদ্ধিজীবিদের গালমন্দ করেছেন, সেই লেখা দিয়ে অনেকেই বুদ্ধিজীবিদের ছোট করতে চান। কিন্ত আফসোসের বিষয় হলো আহমদ ছফা তার গালমন্দের মাধ্যমে কী বার্তা দিতে চেয়েছেন, তা তারা আদৌ ধরতে পারেন না। আহমদ ছফা মনে করতেন বুদ্ধিজীবীরা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে না পারার কারণে দেশ দিন দিন সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠছে! উদ্দেশ্য ধরতে পেরেছেন? হিন্দুরা ক্ষমতা হারাচ্ছে। মোল্লা-মওলবিরা ক্ষমতার চূড়ায় গিয়ে বসছে। এই ছিল আহমদ ছফার সারা জীবনের হতাশা। বুদ্ধিজীবীরা যদি পেটের ধান্দা না করে তাদের দায়িত্ব ভালো করে সম্পাদন করত, তাহলে আর এই পরিস্থিতি দেখত হতো না। কিন্ত আপনারা না-বুঝেই একজন মিলিট্যান্ট সেক্যুলারকে (যুদ্ধবাজ সেক্যুলার) আকাশে উঠিয়ে দেন!

সেক্যুলাররা কোনো দাঙ্গাকেই হিন্দু-মুসলিম বা ধর্মীয় দাঙ্গা হিসেবে প্রথমে মানতে চায় না। এটা শুধু আজকের জন্য নয়, সবসময়ের জন্যই সত্য। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বের করে দেয়া হলো। সেখানে সেক্যুলাররা ছড়িয়ে দিলো যে, সেখানে অনেক দামি মূল্যবান খনিজ থাকার জন্য রোহিঙ্গাদের বের করে দেয়া হয়েছে। জিংজিয়াং-এ মুসলিমদের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হলো। সেখানেও একই তত্ত্ব এসে হাজির। এদের বুদ্ধির সংকীর্ণতা এখানেই যে, তারা দুটো জিনিসকে একসাথে দেখাতে পারে না। কারণ, তারা ধর্মকে এতটাই তাচ্ছিল্য করে যে, এটা মানতে নারাজ ধর্মের জন্য এ রকম দাঙ্গাহাঙ্গামা হতে পারে!

আমি আপনাদের সাথে ছোট একটি ঘটনা শেয়ার করব। ১৯১০ সালের ডিসেম্বর মাসে কুরবানির ঈদে এক মসজিদের সামনে গরু কোরবানিকে কেন্দ্র করে কলকাতায় হিন্দু-মুসলিমের দাঙ্গা শুরু হয়। তৎকালীন গোরক্ষার আন্দোলনটা পুরোপুরি নেতৃত্ব দিত মারোয়ারি ব্যবসায়ীরা। দাঙ্গাতে কতজনের মৃত্যু হয়েছিল তা এখনো স্পষ্ট নয়। এক স্থানে পেয়েছি ছয় জন নিহত হয়। কিন্ত আরেকটি খবরে আমি পাই দেড়শো হিন্দু খুব খারাপভাবে আহত হয়। সে যাই হোক, দাঙ্গার পর পুলিশ আসে তদন্ত করতে। পুলিশ তদন্ত করে রিপোর্ট দেয়, এই দাঙ্গার কারণ যতটা না ধর্মীয় তার চেয়ে বেশি ব্যবসায়িক। এই দাঙ্গার নেতৃত্বে যে মারোয়ারি ব্যবসায়ীরা ছিল, তারা মূলত মসজিদসংলগ্ন বস্তির মালিকানাতে ছিল। সেই বস্তি পরিষ্কার করা হলেও সেখানে নতুন করে কোনো হিন্দু এসে থাকতে চাচ্ছিল না। যেহেতু মসজিদের সামনে গরু জবাই করা হতো। তাই মারোয়ারিরাও কোনো ধনী হিন্দুর কাছে ওই জমি বিক্রি করতে পারছিল না। তাই দাঙ্গা বাধিয়ে এটা যেন বন্ধ করা হয়, সেই উদ্যোগ নেয়। এখন আপনি কি বৃটিশের অধীনে থাকা পুলিশ কমিশনারের এই রিপোর্টে খুশি? চূড়ান্তভাবে সে তো বলেই দিয়েছে এখানে যতটা না ধর্মীয় তার চেয়ে ব্যবসায়িক বিষয়টা বেশি সম্পৃক্ত। মধুখালীর ঘটনা নিয়েও তো আমাদের সো কল্ড ইন্টেলেকচুয়াল সোসাইটির লোকজন এ রকম কোনো সিদ্ধান্তেই পৌঁছাতে চায়।

কিন্ত দেখুন, ওখানে হিন্দুরা ওই জমি কিনছিল না শুধু গরু জবাই হতো এ কারণে। অর্থাৎ এটা একটা ধর্মীয় কারণ। আবার মারোয়ারি ব্যবসায়ীরাও কিন্ত হিন্দুই। এমনকি সে যুগে পুরো ভারতজুড়ে গোরক্ষার আন্দোলন নেতৃত্ব দিয়েছে এই মারোয়ারিরাই। গোরক্ষার আন্দোলন হিসেবে ভারত উপমহাদেশের প্রতিটা রাজ্যে তাদের এজেন্ট নিয়োগ করে। পূর্ববঙ্গের এজেন্ট কে ছিল জানেন? বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যয়। তাকে এই বাংলাদেশে পাঠানো হয় গোরক্ষার আন্দোলনের এজেন্ট হিসেবে। গরু যেন জবাই না-দেয়া হয় এবং গরুকে যেন বিশেষ করে খাতির করা হয় এ জন্য তিনি স্থানে স্থানে বক্তৃতা-লেকচার দিতেন। জমিদারদের সাথে দেখা করতেন। গরুর হালচাল জানতেন। সবকিছু আবার কলকাতাতে রিপোর্ট করে পাঠাতেন। তিনি এই কাজ করতে গিয়ে পূর্ববঙ্গে ঘোরার বিশাল সুযোগ পেয়েছিলেন। নরসিংদী, ফরিদপুর, রাজবাড়ি, মাদারীপুর, বরিশাল, ঝিনাইদহ কোনো জেলা-ই তিনি বাদ রাখেননি। তাহলে বুঝুন মারোয়ারিরা গরু রক্ষার আন্দোলন কতদূর নিয়ে গিয়েছিল! এমনকি স্বামী বিবেকানন্দের কাছে যারা গরুরক্ষার জন্য চাঁদা চাইতে যায়, তারাও এই মারোয়ারি ব্যবসায়ীই ছিল। অর্থাৎ মারোয়ারিরা গরুকে রক্ষা করার জন্য কলকাতাতে যে রায়োট বাধিয়েছিল, তা ধর্মীয় কারণেও বটে। বরং ধর্মীয় কারণই মূল।

তাই, ইন্টেলেকচুয়াল সোসাইটিকে এ নিয়ে কোনো হাঁকডাক দিতে দেখবেন না। মুসলিমদের দুঃখকষ্টগুলো কখনো পুরানো হয় না। কারণ, তা অন্যদের কষ্টের মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে না। বরং ছড়িয়ে যেন না পড়ে, সেই ভূমিকাই মুখ্য থাকে। অর্থাৎ মুসলিমদের কষ্ট সবসময়ই নতুন। যখনই এটা নিয়ে কিছু লিখবেন, তখনই দেখবেন মুসলিমদের এই কষ্ট নিয়ে স্বয়ং মুসলিমদেরই একটা অংশ বেখবর ছিল। যেহেতু মুসলিমদের কষ্টগুলোকে ইস্যু বানানো সম্ভব হয় না, তাই এটা সবসময় মনে হবে নতুন কোনো ঘটনা। এমনকি এখনো অনেকে জানেন না যে মধুখালীতে দুজন মুসলিম শ্রমিককে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। আমি একে কারামত বলি। যেখানে মুসলিমদের কষ্ট কখনো পুরানো হয় না, সজীবই থাকে। এর থেকে বড় কারামত আর কীই বা হতে পারে! আমরা যেন দিন দিন ফেলনা হয়ে যাচ্ছি। যাদের কাছে আমাদের অনুভূতিগুলোর কোনো মূল্য নেই, সেই তাদের দিকেই আমরা চেয়ে থাকি। আমরা যেখানে মোট জনসংখ্যার এত বড় একটা অংশ, নিজেদের কষ্টগুলোকে ইস্যু বানানোর জন্য আমরা নিজেরাই কি কিছু করতে পারি না?

 

Leave a Reply