হুরমাতুল মুসাহারাহ

উসতায শাইখুল ইসলাম (হাফিযাহুল্লাহ)

শুরুর কথা

নারী-পুরুষে বিয়ে শুদ্ধ হওয়ার শর্ত হলো, তাদের মাঝে শরিয়াহ যেসব প্রতিবন্ধকতা দিয়েছে, তা থেকে মুক্ত থাকা। সাধারণত নারী-পুরুষের বেলায় বিয়ের প্রতিবন্ধকতা বোঝাতে আরবি ‘হুরমাতুন’ (حرمة) শব্দ ব্যবহার করা হয়। আর এ থেকেই ‘মাহরাম’ শব্দটা উদ্‌গত হয়েছে। মাহরাম এমন লোকদের বোঝায়, যাদের বিয়ে করা হারাম। প্রতিবন্ধকতা দুভাগে বিভক্ত :

                        ১. স্থায়ী প্রতিবন্ধকতা

                        ২. অস্থায়ী প্রতিবন্ধকতা

১. স্থায়ী প্রতিবন্ধকতা ৩টি :

  • বংশগত (হুরমাতুন নাসাব)
  • বৈবাহিক সম্পর্কজনিত (হুরমাতুল মুসাহারা)
  • দুধপানজনিত (হুরমাতুর রাদাআহ)

২. অস্থায়ী প্রতিবন্ধকতাও ৩টি :

  • একই পুরুষ দুই পারস্পরিক মাহরাম নারীকে একসাথে বিয়ের বন্ধনে রাখা
  • কোনো নারীর মাঝে অন্য পুরুষের অধিকার (বিয়ে ইত্যাদি) বহাল থাকা
  • উভয়ের দ্বীন ভিন্ন হওয়া

বংশগত প্রতিবন্ধকতা : বংশগত প্রতিবন্ধকতাকে ‘হুরমাতুন নাসাব’ বলে। কুরআনে পুরুষের জন্য নিজ বংশের যে সাত শ্রেণির নারীকে বিয়ে করা হারাম বলা হয়েছে, এটা এই প্রকারেরই অন্তর্ভুক্ত। এগুলো মনে রাখার সহজ উসুল ৪টি :

 ১. পুরুষের ঊর্ধ্বতন নারী

২. পুরুষের অধঃস্তন নারী

৩. মা-বাবার অধঃস্তন নারী

৪.  দাদা-দাদি, নানা-নানি এবং তাদের ঊর্ধ্বতন সকল অধঃস্তন নারী

১ম প্রকারের অন্তর্ভুক্ত মা, দাদি, নানি এবং এর ওপরে যারা আছে সবাই। ২য় প্রকারের ভেতর পড়ে মেয়ে, মেয়ের মেয়ে, পুত্রের মেয়ে এবং এর নিচে যারা আছে সবাই। ৩য় প্রকারে বোন, ভাগ্নি, ভাতিজি এবং এর নিচে যারা আছে সবাই অন্তর্ভুক্ত। ৪র্থ প্রকারের অন্তর্ভুক্ত হলো, নিজের ফুফু ও খালা, বাবা-মায়ের ফুফু ও খালা, দাদা-দাদি ও নানা-নানির ফুফু ও খালা এবং এভাবে যত ওপরে যাবে সবাই। কুরআন সবগুলোকে একবাক্যে উল্লেখ করে দিয়েছে,

حُرِّمَتْ عَلَيْكُمْ أُمَّهاتُكُمْ وَبَناتُكُمْ وَأَخَواتُكُمْ وَعَمَّاتُكُمْ وَخالاتُكُمْ وَبَناتُ الأَخِ وَبَناتُ الأُخْتِ

‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে নিজের মাদেরকে, মেয়েদেরকে, বোনদেরকে, ফুফুদেরকে, খালাদেরকে, ভাইয়ের মেয়েদেরকে এবং বোনের মেয়েদেরকে।’[১]

বৈবাহিক সম্পর্কজনিত প্রতিবন্ধকতা : বৈবাহিক সম্পর্কের ফলে যে হুরমাত বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়, তাকে ‘হুরমাতুল মুসাহারা’ বলে। এটিই এখানকার মূল আলোচ্য বিষয়।

দুধপানজনিত প্রতিবন্ধকতা : ভিন্ন দুই শিশু একই মহিলার দুধপানের কারণে উভয়ের পারস্পরিক বিয়েতে এবং দুধপানকারীর সাথে দুধমা ও তার মাহরাম স্বজনদের বৈবাহিক সম্পর্কে যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়, তাকে ‘হুরমাতুর রাদাআহ’ বলে। এটা নিয়ে ভিন্ন আর্টিকেলে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে, ইনশাআল্লাহ।

মূল আলোচনা

হুরমাতুল মুসাহারাহ (حرمة المصاهرة) হলো, বৈবাহিক সম্পর্কের ফলে নারী-পুরুষ উভয়ের মাহরাম আত্মীয়-স্বজন অপরজনের জন্য হারাম হওয়া। যেমন স্ত্রীর মা। স্ত্রী জীবিত থাকুক বা মৃত, কোনো অবস্থাতেই স্বামীর জন্য স্ত্রীর মাকে বিয়ে করা বৈধ নয়। বরং সেটা হারাম। তেমনিভাবে স্বামীর পিতা। স্বামী মারা গেলে বা তালাক দিয়ে দিলে শশুরকে বিয়ে করা যাবে না। হুরমাতুল মুসাহারাহর মাসআলা দুই ধরনের হয় :

                        ১. ঐকমত্যপূর্ণ

                        ২. মতভেদপূর্ণ।

এর বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হলো।

১. ঐকমত্যপূর্ণ মাসআলা

ঐকমত্যপূর্ণ মাসআলায় পুরুষের জন্য চার শ্রেণির নারী হুরমাতুল মুসাহারাহর অন্তর্ভুক্ত। একে ৪ প্রকারও বলা যায়। যথা :

                        ১. স্ত্রীর ঊর্ধ্বতন নারী

                        ২. সহবাসকৃতা স্ত্রীর অধঃস্তন নারী

                        ৩. পুরুষের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের স্ত্রী

                        ৪. তার অধঃস্তন ব্যক্তিদের স্ত্রী

  • বিস্তারিত বিবরণ

১. স্ত্রীর ঊর্ধ্বতন নারী : যেমন স্ত্রীর মা, স্ত্রীর দাদি ও নানি, পরদাদি ও পরনানি ইত্যাদি যত ওপরে যাবে সবাই এর অন্তর্ভুক্ত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেছেন,

وَأُمَّهاتُ نِسائِكُمْ

‘তোমাদের স্ত্রীদের মাদেরকে তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে।’[২]

২. সহবাসকৃতা স্ত্রীর অধঃস্তন নারী : অর্থাৎ, বিয়ের পর যে স্ত্রীর সাথে সহবাস হয়েছে। যদি তার গর্ভজাত এমন কোনো মেয়ে থাকে, যে আগের স্বামীর ঔরস থেকে জন্মলাভ করেছে, তাকে বিয়ে করা যাবে না। এমনকি স্ত্রীর কোনো দুধমেয়ে থাকলে তাকেও বিয়ে করা যাবে না। আর যদি সহবাস হওয়ার আগেই স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেয় বা স্ত্রী মারা যায়, তাহলে তার মেয়েকে বিয়ে করতে সমস্যা নেই। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেছেন,

وَرَبَائِبُكُمُ اللَّاتِي فِي حُجُورِكُمْ مِنْ نِسَائِكُمُ اللَّاتِي دَخَلْتُمْ بِهِنَّ فَإِنْ لَمْ تَكُونُوا دَخَلْتُمْ بِهِنَّ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ

‘যেসব স্ত্রীর সাথে সহবাস করেছ, তাদের আগের স্বামীর ঔরসের তার গর্ভজাত মেয়ে, যারা তোমাদের অভিভাবকত্বে আছে, তাদের বিয়ে করা তোমাদের জন্য হারাম। তবে যদি তাদের সাথে সহবাস না-করে থাক, তবে তোমাদের কোনো অপরাধ নেই।’[৩]

৩. পুরুষের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের স্ত্রী : অর্থাৎ সৎ মা, সৎ দাদি, সৎ নানি, সৎ পরদাদি ও পরনানি ইত্যাদি যত  ওপরে যাবে সবাই এর অন্তর্ভুক্ত। চাই স্বামীরা তাদের সাথে সহবাস করুক বা না-করুক। আল্লাহ বলেন,

وَلا تَنْكِحُوا ما نَكَحَ آباؤُكُمْ مِنَ النِّساءِ

‘তোমাদের পিতৃপুরুষরা যে নারীদের বিয়ে করেছে, তোমরা তাদের বিয়ে কোরো না।’[৪]

এখানে সৎ মা, সৎ দাদি ও সৎ নানির পাশাপাশি সৎ বোন, সৎ ভাগ্নি ইত্যাদি যত নিচের দিকে যাবে তারাও এর অন্তর্ভুক্ত হবে। কারণ, তারা পিতার ঔরসজাত সন্তান, যা হুরমাতুন নাসাবের অন্তর্ভুক্ত।

৪. পুরুষের অধঃস্তন ব্যক্তিদের স্ত্রী : এর অন্তর্ভুক্ত হলো—পুত্রবধু, নাতির বউ, নাতির ছেলের বউ ইত্যাদি যত নিচে যাবে। চাই তাদের সাথে সহবাস হোক বা না-হোক। এ ক্ষেত্রে পুরুষের ঔরসজাত অধঃস্তন ব্যক্তিদের স্ত্রী হওয়া শর্ত। আল্লাহ বলেছেন,

وَحَلائِلُ أَبْنائِكُمُ الَّذِينَ مِنْ أَصْلابِكُمْ

‘আর তোমাদের ঔরসজাত ছেলেদের স্ত্রীরা তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ।’[৫]

এই পর্যন্ত হুরমাতুল মুসাহারার ঐকমত্যপূর্ণ মাসআলার বিবরণ গেল। এবার আমরা মতভেদপূর্ণ মাসআলা সম্পর্কে জানব, ইনশাআল্লাহ।

. মতভেদপূর্ণ মাসআলা

যেহেতু বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে কিছু সংখ্যক নারী-পুরুষের পারস্পরিক বিয়ে হারাম হয়ে যায়, তাই এখানে প্রাসঙ্গিকভাবেই আরেকটা মাসআলা আলোচিত হয়। সেটা হলো, যেহেতু আরবি ‘নিকাহ’ শব্দটি ‘বিয়ের আকদ’ ও ‘সহবাস’ এই দুই অর্থেই ব্যবহৃত হয়, তাই আকদ (বিয়ে) দ্বারা হুরমাত (হারাম হওয়া) সাব্যস্ত হওয়া এবং আকদ ছাড়া শুধু সহবাস (ব্যভিচার) দ্বারা হুরমাতুল মুসাহারাহ সাব্যস্ত হওয়া বিধানগত একই বিষয় কি না, সেটা। ইতিপূর্বের আলোচনায় জেনে এসেছি যে, কিছু ক্ষেত্রে শুধু আকদ (বিয়ে) দ্বারাই হুরমাত সাব্যস্ত হয়। আর কিছু ক্ষেত্রে হুরমাত সাব্যস্ত হওয়ার জন্য আকদের পর সহবাস হওয়া আবশ্যক। কিন্তু আকদ ছাড়া শুধু সহবাস—যা যিনা (ব্যভিচার) হিসেবে বিবেচিত—এর দ্বারা হুরমাত (হারাম হওয়া) সাব্যস্ত হয় কি না, এই বিষয়ে ইমামদের মতভেদ রয়েছে। ইমাম শাফিয়ি রাহিমাহুল্লাহর মতে এবং মালিক রাহিমাহুল্লাহর এক মত অনুযায়ী ব্যভিচার দ্বারা হুরমাত সাব্যস্ত হয় না।

আর ইমাম আবু হানিফা ও আহমাদ রাহিমাহুমাল্লাহ এবং মালিক রাহিমাহুল্লাহর অপর মত অনুযায়ী ব্যভিচারের ফলে হুরমাত সাব্যস্ত হয়। অর্থাৎ, প্রথম মত অনুযায়ী—যে মহিলার সাথে যিনা হয়েছে, যিনাকারী পুরুষের জন্য ওই মহিলার মা, মেয়ে এবং অন্যান্য মাহরাম আত্মীয় বিয়ে করা বৈধ। আর দ্বিতীয় মত অনুযায়ী অবৈধ। এমনকি হানাফি মতে চুমু, স্পর্শ এবং গোপনাঙ্গের প্রতি উত্তেজনাবশত দৃষ্টি দিলেও হুরমাত সাব্যস্ত হবে। এখানে আরেকটি বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত। তা হলো, যে স্ত্রীর সাথে সহবাস হয়নি, শুধু স্পর্শ, চুমু ইত্যাদি হয়েছে, তারপর তাকে তালাক দেয়া হয়েছে বা সে মারা গেছে—এমতাবস্থায় তার আগের স্বামীর ঔরসজাত মেয়েকে বিয়ে করা যাবে কি না। এখানে আমরা প্রতিটি মতকে দালিলিকভাবে বিশ্লেষণ করব, ইনশাআল্লাহ। আর হাদিসগুলোর বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের জন্য যেহেতু সনদের প্রয়োজন হয়, তাই প্রতিটি হাদিসের সাথে এর সনদও উল্লেখ করা হবে।

হুরমাত সাব্যস্ত হওয়ার পক্ষে যেসব দলিল পেশ করা হয় :
প্রথম দলিল

আল্লাহ বলেছেন,

وَلَا تَنكِحُوا مَا نَكَحَ آبَاؤُكُم مِّنَ النِّسَاءِ إِلَّا مَا قَدْ سَلَفَ ، إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَمَقْتًا وَسَاءَ سَبِيلًا

‘তোমাদের পিতৃপুরুষ যেসব নারীকে ‘নিকাহ’ (বিয়ে) করেছে, তাদেরকে বিয়ে কোরো না। তবে আগে যা সংঘটিত হয়েছে (ক্ষমা করা হলো)। অবশ্যই  সেটা ছিল অশ্লীল, মারাত্মক ঘৃণ্য ও নিকৃষ্ট পন্থা।’[৬]

আয়াতে ‘নিকাহ’ শব্দ দ্বারা সহবাস উদ্দেশ্য। কারণ এটাই শব্দের হাকিকি (আসল) অর্থ। রূপক অর্থে বিয়ে বোঝায়। তাই এর অর্থ হলো, তোমাদের পিতৃপুরুষেরা যাদের সাথে সহবাস (বৈধ হোক বা অবৈধ) করেছে, তাদের বিয়ে কোরো না।

হুরমাতুল মুসাহারাহ নিয়ে আপত্তি

বিপরীত পক্ষ থেকে উক্ত দলিলের ব্যাপারে বলা হয়, এই আয়াতে ‘নিকাহ’ অর্থ সহবাস নয়, বরং বিয়ে। কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে ‘সহবাস’ বোঝাতে ‘দুখুল’ (دخول), ‘মুলামাসা’ (ملامسة) ইত্যাদি মাসদার থেকে ক্রিয়াপদ এনে পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, আল্লাহ হুরমাতের তালিকায় বলেছেন,

وَأُمَّهَاتُ نِسَائِكُمْ وَرَبَائِبُكُمُ اللاتِي فِي حُجُورِكُمْ مِنْ نِسَائِكُمُ اللاتِي دَخَلْتُمْ بِهِنَّ فَإِنْ لَمْ تَكُونُوا دَخَلْتُمْ بِهِنَّ فَلَا جُنَاحَ عَلَیۡكُمۡ

‘তোমাদের স্ত্রীদের মা (শাশুড়ি) এবং তোমরা যাদের সাথে ‘দুখুল’ (সহবাস) করেছ, সে স্ত্রীদের সেসব কন্যা, যারা তোমাদের লালন-পালনে আছে (তারা তোমাদের জন্য হারাম)। যদি তাদের (স্ত্রী) সাথে সহবাস না-করে থাক, তবে এ বিয়েতে তোমাদের কোনো পাপ নেই।’[৭]

এ আয়াতে আল্লাহ স্পষ্ট করেছেন যে, যে স্ত্রীর সাথে ‘দুখুল’ (সহবাস) হয়েছে, তার মেয়েকে (আগের স্বামীর ঔরসজাত) বিয়ে করা হারাম। তবে ‘দুখুল’ (সহবাস) না হয়ে থাকলে বিয়ে করতে পারবে। এখানে সহবাস বোঝাতে ‘দুখুল’ শব্দ উল্লেখ করেছেন, ‘নিকাহ’ শব্দ উল্লেখ করেননি। তাই প্রতিপক্ষের পেশকৃত আয়াত ‘তোমাদের পিতৃপুরুষ যেসব নারীকে নিকাহ (বিয়ে) করেছে, তোমরা তাদের বিয়ে কোরো না।’-এ ‘নিকাহ’ বা বিয়ে শব্দটি বাপ-দাদার সহবাসকৃত (বিয়েহীনা) মহিলাকে বোঝায়নি; বরং সৎমা, সৎদাদি প্রমুখকে বিয়ের নিষিদ্ধতা বর্ণনা করেছে। নয়তো আয়াতে ‘নিকাহ’ দ্বারা যদি সহবাসই উদ্দেশ্য হতো, তাহলে যেসব সৎমা ও সৎদাদির সাথে বাপ-দাদার সহবাস হয়নি, তাদের বিয়ে করা বৈধ হয়ে যেত। (ইতিপূর্বে আমরা জেনে এসেছি যে, তাদেরকে বিয়ে করা হারাম।)

দ্বিতীয়ত, أُمَّهَاتُ نِسَائِكُمْ বাক্যে বিয়ের মাধ্যমে বন্ধনযুক্ত স্ত্রীর মা (শাশুড়ি)-কে বিয়ে করা হারাম বলা হয়েছে। যিনাকৃত মহিলার মাকে বোঝায়নি। কারণ, ‘নিসা’ শব্দটি স্ত্রীকেই বুঝিয়ে থাকে, যার সাথে বিয়ের বন্ধন হয়েছে, সহবাস হোক বা না-হোক। উক্ত আয়াত থেকেই প্রমাণ হয় যে, শুধু সহবাস (যিনা) দ্বারা হুরমাত সাব্যস্ত হয় না। বরং বিয়ে দ্বারাই সাব্যস্ত হয়। (ইতিপূর্বে আমরা জেনে এসেছি যে, শাশুড়িকে বিয়ে করা হারাম। চাই স্ত্রীর সাথে সহবাস হোক বা না হোক।)

তৃতীয়ত, তাঁদের পেশকৃত আয়াতে শুধু বাপ-দাদার সহবাসকৃত মহিলাদের কথা বলা হয়েছে। অথচ অন্য লোকদের ক্ষেত্রে এই বিধান প্রয়োগ করার প্রমাণ নেই। আর তাঁদের মতানুযায়ী পুত্র কর্তৃক যিনাকৃত মহিলাকে বিয়ে করাও হারাম। অথচ সেটা হারাম হওয়ারও দলিল নেই। বরং এর বিপরীতে আল্লাহ বলেছেন, وَحَلائِلُ أَبْنائِكُمُ । এখানে حَلائِلُ শব্দটি حَلِيلَة শব্দের বহুবচন। যার অর্থ হলো, স্ত্রী, পত্নী, সহধর্মিণী। অর্থাৎ ‘তোমাদের সন্তানদের স্ত্রীরা (বিয়ের মাধ্যমে যারা স্ত্রী হয়েছে) তোমাদের জন্য হারাম।’ এর অর্থ দাঁড়ায়, সন্তান কোনো নারীর সাথে বিয়ে ছাড়া হারাম উপায়ে সহবাস করলে পিতা তাকে বিয়ে করতে পারবে, এটা পিতার জন্য হারাম হবে না। এ থেকেও প্রমাণ হয় যে, যিনা দ্বারা হুরমাত সাব্যস্ত হয় না।

চতুর্থত, তাঁদের পেশকৃত আয়াতটি নাযিলের প্রেক্ষাপট ছিল সাহাবি আবু কাইস রাদিয়াল্লাহ আনহু মারা যাওয়ার পর তাঁর ছেলে সৎমাকে বিয়ে করতে চাওয়া। এই পরিপ্রেক্ষিতেই আয়াতটি নাযিল হয় এবং নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

দ্বিতীয় দলিল

ইমাম ইবনু আবি শাইবাহ বর্ণনা করেছেন,

حدثنا جرير بن عبد الحميد عن حجاج عن أبي هاني قال: قال رسول اللَّه صلى اللَّه عليه وسلم من نظر إلى  فرج امرأة لم تحل له أمها ولا ابنتها

‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো মহিলার গোপনাঙ্গে দৃষ্টি দিল, তার জন্য ওই মহিলার মা ও মেয়েকে বিয়ে করা বৈধ নয়।’[৮]

হাদিসের মান : হাদিসটা দয়িফ ও মুনকার। এর সনদে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনাকারী হিসেবে আবু হানির নাম উল্লেখ রয়েছে। আর আবু হানি থেকে বর্ণনা করেছেন হাজ্জাজ। ইমাম বাইহাকির ভাষ্যে তিনি হলেন হাজ্জাজ ইবনু আরতাহ। প্রথমত, তার ব্যাপারে মুহাদ্দিস কিরামের ‘জারহ’ বা নেতিবাচক মন্তব্য প্রসিদ্ধ। তিনি প্রসিদ্ধ মুদাল্লিস। এমনকি অনেকে তো তার বর্ণিত হাদিস দলিলযোগ্য নয় বলেও মত দিয়েছেন। আর কোনো মুদাল্লিস রাবি যখন ‘আন’ শব্দ দিয়ে বর্ণনা করে, তখন তার বর্ণনা পরিত্যাজ্য বলে বিবেচিত হয়। এখানেও তা-ই হয়েছে। দ্বিতীয়ত, তিনি আবু হানি থেকে বর্ণনা করেছেন বলে সনদে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু আবু হানি লোকটি কে তা অজ্ঞাত। তাই মাজহুল রাবির কারণেও আরেকটি ত্রুটির সৃষ্টি হলো। অনেকে আবু হানির স্থলে ‘উম্মু হানি’ বলেছেন। কিন্তু সেটাও আরেকটা জটিলতার সৃষ্টি করে। কারণ এই নামে প্রায় দশজন ব্যক্তির প্রসিদ্ধি আছে। এখানে কোন উম্মু হানি তা অজ্ঞাতই। যদি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফুফু উদ্দেশ্য হন, তাহলে আরেক জটিলতা সৃষ্টি হবে। কারণ, তাঁর সাথে হাজ্জাজের সাক্ষাৎ হওয়া দূরের কথা, তিনি থাকতে হাজ্জাজের জন্মই হয়নি। তৃতীয়ত, সনদে ইনকিতা বা বিচ্ছিন্নতা যেহেতু স্পষ্ট, তাই রাবি দয়িফ হওয়ার পাশাপাশি সনদ মুনকাতি ও মুরসালও। এ জন্য বাইহাকি, ইবনু হাজার, আলবানি প্রমুখ ইমাম এ হাদিসকে দয়িফ ও অগ্রহণযোগ্য বলে মত দিয়েছেন।[৯]

 তৃতীয় দলিল

ইমাম আবদুর রাযযাক বর্ণনা করেছেন,

عَنِ ابْنِ جُرَيْجٍ، قَالَ: أُخْبِرتُ عَنْ أَبِي بَكْرِ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ عَنِ ابْنِ أُم الْحَكَمِ، أَنَّهُ قَالَ: قَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، إِنِّي زَنَيْتُ بِامْرَأَةٍ فِي الْجَاهِلِيَّةِ أَفَأَنْكِحُ ابْنَتِهَا؟ فَقَالَ النَّبِيُّ – صلى الله عليه وسلم -: لَا أَرَى ذَلِكَ، وَلَا يَصْلُحُ ذَلِكَ، أَنْ تَنْكِحَ امْرَأَةَ تَطَّلِعُ مِنِ ابْنَتِهَا عَلَى مَا اطَّلَعْتَ عَلَيْهِ مِنْهَا

‘এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, “হে আল্লাহর রাসুল, আমি জাহিলি যুগে এক মহিলার সাথে যিনা (ব্যভিচার) করেছিলাম। এখন কি ওর মেয়েকে বিয়ে করতে পারব?” জবাবে তিনি বললেন, “আমি এটা বৈধ মনে করি না। আর তা বৈধ হওয়ার উপযুক্তও নয় যে, মহিলার যে বিষয়টা তুমি জেনেছ, বিয়ে করে তার মেয়েরও সে বিষয়টা তুমি জানবে।”’[১০]

হাদিসের মান : এই হাদিসও দয়িফ এবং দলিলযোগ্য নয়। এর সনদে আবু বাকর ইবনু আবদির রাহমান নামক বর্ণনাকারী মাজহুল (অজ্ঞাত)।

চতুর্থ দলিল

ইমাম ইবনু আবি শাইবাহ বর্ণনা করেছেন,

حدثنا أبو بكر قال: نا علي بن مسهر عن سعيد عن قتادة عن الحسن عن عمران بن الحصين الرجل يقع على أم امرأته قال: تحرم عليه امرأته

‘সাহাবি ইমরান ইবনু হুসাইন থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি শাশুড়ির সাথে যিনায় লিপ্ত হলে তিনি বললেন—ওর জন্য স্ত্রী হারাম হয়ে গেছে।’[১১]

বর্ণনার মান : এটাও দয়িফ। এর সনদে ‘সায়িদ ইবনু আবি আরুবাহ’ আছেন, যাঁর ব্যাপারে মুহাদ্দিস কিরাম বলেছেন, তিনি শেষ বয়সে হাদিস বর্ণনায় এলোমেলো ও তালগোল পাকিয়ে ফেলতেন। হাদিসশাস্ত্রের পরিভাষায় যাকে ‘ইখতিলাত’ (اختلاط) বলা হয়। ইমাম বুখারি (রাহিমাহুল্লাহ) ‘সহিহ’ গ্রন্থে তাঁর থেকে ‘ইখতিলাত’ হওয়ার আগের বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এখানে উল্লিখিত বর্ণনাটা ইখতিলাতের আগের না কি পরের, তা সুস্পষ্ট নয়। বর্ণনায় এমন অস্পষ্টতা কোনো বিধান সাব্যস্ত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক। উসুলুল হাদিসের প্রসিদ্ধ কিতাব ‘মুকাদ্দিমাতু ইবনিস সালাহ’তে ইমাম ইবনুস সালাহ লিখেছেন,

لَا يُقْبَلُ حَدِيثُ مَنْ أُخِذَ عَنْهُ بَعْدَ الِاخْتِلَاطِ، أَوْ أُشْكِلَ أَمْرُهُ فَلَمْ يُدْرَ هَلْ أُخِذَ عَنْهُ قَبْلَ الِاخْتِلَاطِ  أَوْ بَعْدَهُ

‘ইখতিলাত হওয়ার পর যেসব রাবি থেকে হাদিস নেয়া হয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। তেমনিভাবে ওই রাবির হাদিসও গ্রহণযোগ্য নয়, যার বিষয়টা অনিশ্চিত হয়ে আছে। অর্থাৎ জানা নেই যে, তার কাছ থেকে হাদিসটি ইখতিলাতের আগে নেয়া হয়েছে না কি পরে।’[১২]

উপরন্তু এটা একজন সাহাবির একক উক্তি হিসেবে বর্ণিত। তা আবার উল্লিখিত কুরআনের মাফহুমেরও (বুঝ) বিপরীত। আবার এই বর্ণনা হাদিসের উসুল অনুযায়ীও গ্রহণযোগ্য নয়। উপরন্তু সায়িদ ইবনু আবি আরুবাহ একে তো দয়িফ রাবি, তদুপরি তিনি সাহাবি ইমরান ইবনু হুসাইনের বক্তব্যের বিপরীতে আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস থেকে ভিন্ন বক্তব্যও বর্ণনা করেছেন। ইবনু আবি শাইবাহ এটি উল্লেখ করেছেন,

الرجل يقع على أم امرأته أو ابنة امرأته ما حال امرأته؟ حدثنا علي بن مسهر عن سعيد عن قتادة عن يحيى بن يعمر عن ابن عباس قال: حرمتان أن يخطاهما ولا يحرمها ذلك عليه

‘এক লোক তার শাশুড়ির সাথে কিংবা স্ত্রীর মেয়ের সাথে যিনা (ব্যভিচার) করেছে। তাই, এখন তার স্ত্রীর কী হবে এ ব্যাপারে ইবনু আব্বাস বলেছেন, সে দুটো হুরমাতের দিকে গিয়েছে (অর্থাৎ, মাহরামের সাথে হারাম কাজে লিপ্ত হয়েছে)। তবে সেটা তার স্ত্রীকে হারাম করবে না।’[১৩]

উভয় সাহাবির বর্ণনাতেই বর্ণনাকারী সায়িদ ইবনু আবি আরুবাহ রয়েছেন। আবার উভয়টাই পরস্পরবিরোধী বর্ণনা।

যাঁদের মতে ব্যভিচার, চুমু, স্পর্শ ও গোপনাঙ্গে দৃষ্টিপাত দ্বারা হুরমাত সাব্যস্ত হয় না, তাঁদের দলিল :
প্রথম দলিল

যেসব মহিলাকে বিয়ে করা হারাম, আল্লাহ ‘সুরা নিসা, ৪ : ২৩-২৪’-এ তাদের একটি তালিকা দিয়ে তারপর বলেছেন,

وَأُحِلَّ لَكُمْ مَا وَرَاءَ ذَلِكُمْ

‘উল্লেখিত নারীরা ছাড়া অন্য নারীকে তোমাদের জন্য বৈধ করা হলো।’

তিনি হুরমাতের তালিকায় যার সাথে যিনা হয়েছে তার মা ও মেয়েকে অন্তর্ভুক্ত করেননি। তাই যিনা দ্বারা হুরমাত সাব্যস্ত হবে না।

দ্বিতীয় দলিল

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

لَا يُحَرِّمُ الْحَرَامُ الْحَلَالَ

‘হারাম বিষয় হালালকে হারাম করে না।’

হাদিসের মান : এ হাদিস ৩ জন সাহাবি থেকে ভিন্ন ভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে। প্রতিটি বর্ণনার বিস্তারিত তাহকিক পেশ করা হলো :

এক. সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনু উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, যা ইমাম ইবনু মাজাহ তাঁর সুনানে উল্লেখ করেছেন। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

لَا يُحَرِّمُ الْحَرَامُ الْحَلَالَ

‘হারাম বিষয় হালালকে হারাম করে না।’[১৪]

হাদিসটা দয়িফ। এর সনদে আবদুল্লাহ ইবনু উমার ইবনি হাফস ইবনি আসিম ইবনি উমার ইবনিল খাত্তাব নামক বর্ণনাকারী দয়িফ। যদিও ইমাম দারিমি, আহমাদ বিন হাম্বল, ইবনু মায়িন, ইবনু আদি, যাহাবি প্রমুখ তাকে দয়িফ বলেননি। সনদে উল্লিখিত ইসহাক ইবনু মুহাম্মাদ নামক আরেকজন বর্ণনাকারীর ব্যাপারেও স্মৃতিশক্তির কিছুটা দুর্বলতার অভিযোগ রয়েছে।

দুই. হাদিসটা আয়িশাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকেও কিছু অতিরিক্ত কথাসহ বর্ণিত আছে, যা ইমাম তাবারানি রাহিমাহুল্লাহ ‘আল-মুজামুল আওসাত’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। আয়িশাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেন,

سُئِلَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، عَنِ الرَّجُلِ يَتْبَعُ الْمَرْأَةَ حَرَامًا، أَيَنْكِحُ أُمَّهَا؟ أَوْ يَتْبَعُ الْأُمَّ حَرَامًا، أَيَنْكِحُ ابْنَتَهَا؟ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا يُحَرِّمُ الْحَرَامُ  الْحَلَالَ، إِنَّمَا يُحَرِّمُ مَا كَانَ بِنِكَاحٍ حَلَالٍ

‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এমন ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো, যে এক নারীর সাথে অবৈধভাবে মিলিত হয়। এখন সে কি ওর মাকে বিয়ে করতে পারবে? কিংবা মেয়ের মায়ের সাথে অবৈধ মিলন করে। তাই সে মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে কি? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হারাম বিষয় হালালকে হারাম করে না। তবে হালাল বিয়ের দ্বারা হারাম সাব্যস্ত হয়।’[১৫]

এই বর্ণনা পরিত্যাজ্য। এটা দয়িফ জিদ্দান। এর সনদে উসমান ইবনু আবদির রাহমান আয-যুহরি নামক বর্ণনাকারী মুহাদ্দিসদের কাছে মাতরুক (পরিত্যাজ্য)। এমনকি অনেক ইমাম বলেছেন, সে বানোয়াট হাদিস বর্ণনা করত। এই সনদের আরেকটা সমস্যা হলো, উল্লিখিত ‘উসমান’ থেকে বর্ণনাকারী ‘মুগিরাহ ইবনু ইসমায়িল’ একজন মাজহুল (অজ্ঞাত) ব্যক্তি।

তিন. হাদিসটি আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকেও বর্ণিত হয়েছে, যা ইমাম বাইহাকি রাহিমাহুল্লাহ ‘আস-সুনানুল কুবরা’য় উল্লেখ করেছেন। ইবনু শিহাব যুহরিকে এক লোক সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো, যে শাশুড়ির সাথে যিনা করেছে। তিনি বললেন,

قَالَ عَلِيُّ بْنُ أَبِي طَالِبٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ: لَا يُحَرِّمُ الْحَرَامُ  الْحَلَالَ

‘আলি ইবনু আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন—হারাম বিষয় হালালকে হারাম করে না।’[১৬]

এটা ‘মাওকুফ’ বর্ণনা (সাহাবির বক্তব্য)। অথচ এই হাদিসই আগে উল্লিখিত দুজন সাহাবি থেকে ‘মারফু’ সূত্রে (রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী হিসেবে) বর্ণিত হয়েছে। আবার এই মাওকুফ বর্ণনাতে সনদগতভাবে ‘ইনকিতা’ বা বিচ্ছিন্নতাও রয়েছে। সেটা হলো, ইবনু শিহাব যুহরি (রাহিমাহুল্লাহ) আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুর বক্তব্য বর্ণনা করেছেন, অথচ তিনি আলির সাক্ষাৎ পাননি। আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুর মৃত্যুর অনেক পরে প্রায় ৫০ হিজরিতে তাঁর জন্ম। তাই দুজনের মাঝে এক কিংবা একাধিক বর্ণনাকারী বাদ পড়েছে। এই হিসেবে এটা মুরসালের অন্তর্ভুক্ত।

তৃতীয় দলিল

ইমাম আবদুর রাযযাক বর্ণনা করেছেন,

عَنْ مَعْمَرٍ، عَنْ قَتَادَةَ، قَالَ: سُئِلَ ابْنُ عَبَّاس عَنِ الرَّجُلِ يَزْنِي بِأُمِّ امْرَأَتِهِ، قَالَ: تَخَطَّى بِحُرمَةٍ إِلَى حُرْمَةٍ، وَلَمْ تَحْرُمْ عَلَيْهِ امْرَأَتُهُ

‘শাশুড়ির সাথে যিনাকারী এক ব্যক্তি সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন—সে এক হুরমাতের দ্বারা আরেক হুরমাতে চলে গেছে (অর্থাৎ, মাহরামের সাথে হারাম কাজে লিপ্ত হয়েছে), কিন্তু স্ত্রী ওর জন্য হারাম হয়নি।’[১৭]

বর্ণনার মান : এটিও মাওকুফ (সাহাবির বক্তব্য) এবং এর বর্ণনাকারীরা যদিও নির্ভরযোগ্য, তবে সনদে কিছু সমস্যা রয়েছে। তা হলো, ইবনু আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে ‘কাতাদাহ’ বর্ণনা করেছেন, আর তাঁর কাছ থেকে মামার। মুহাদ্দিস কিরাম মামারের বর্ণিত হাদিস গ্রহণ করলেও কাতাদাহ থেকে মামার বর্ণনা করলে সেটা গ্রহণ করেননি। এই ক্ষেত্রে তাঁরা তাঁকে দয়িফ বলেছেন। মামার নিজেই স্বীকার করেছেন যে,

جلست إلى قتادة  وأنا صغير، فلم أحفظ عنه الأسانيد

‘আমি ছোটবেলায় কাতাদাহর কাছে বসেছি। তবে তাঁর কাছ থেকে সনদ সংরক্ষণ করিনি।’[১৮]

এই সনদে কিছু সমস্যা থাকলেও আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে অন্য একটি বক্তব্য সহিহ সনদে বর্ণিত হয়েছে, যা ইমাম ইবনু আবি শাইবাহ বর্ণনা করেছেন,

في الرجل يزني بأخت امرأته، ما حال امرأته عنده؟ حدثنا عبد الأعلى عن هشام عن قيس بن سعد عن عطاء عن ابن عباس قال: جاوز حرمتين إلى حرمة ولم تحرم عليه امرأته

‘এক লোক স্ত্রীর বোনের সাথে যিনা করেছে। এখন তার স্ত্রীর কী হবে, এ ব্যাপারে ইবনু আব্বাস বলেছেন—সে একটা হুরমাতের দিকে গিয়ে দুই হুরমাত অতিক্রম করেছে, তবে ওর স্ত্রী হারাম হয়নি।’[১৯]

বর্ণনার মান : এ আসারটি সহিহ।

উভয় মতের দলিলগুলোর সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা

প্রথম মতের পক্ষে প্রথম দলিল হিসেবে যে আয়াত পেশ করা হয়েছে, সেটার ইসতিদলালের (দলিলগ্রহণ) ওপর দ্বিতীয় মতের পক্ষ থেকে একাধিক দলিলভিত্তিক আপত্তি উত্থাপনসহ তাঁদের (দ্বিতীয় পক্ষ) পেশকৃত আয়াতের আলোকে—যা তাঁদের স্বপক্ষে প্রথম দলিল হিসেবে পেশ করা হয়েছে—দ্বিতীয় মতটিই রাজিহ (অগ্রগণ্য) প্রমাণিত হয়।

প্রথম মতের দ্বিতীয় দলিল হিসেবে আবু হানি কর্তৃক বর্ণিত যে হাদিস পেশ করা হয়েছে, সেটার তাহকিকি আলোচনায় দেখানো হয়েছে যে, এতে অনেকগুলো ত্রুটি রয়েছে। ফলে এটা প্রমাণ পেশ করার উপযুক্ত নয়।

তৃতীয় দলিল হিসেবে পেশকৃত হাদিসও মাজহুল রাবির বর্ণিত হওয়ায় প্রমাণের উপযুক্ত নয়।

প্রশ্ন হতে পারে যে, উক্ত হাদিসদুটো দয়িফ হওয়া সত্ত্বেও উভয়টি মিলে তো হাসান লি-গাইরিহি হতে পারে।

উল্লেখ্য যে, একাধিক দয়িফ মিলে হাসান হওয়াটা শর্তসাপেক্ষ। এর একটি শর্ত হলো, দয়িফগুলো যেন সাধারণ পর্যায়ের হয়। দয়িফ জিদ্দান বা মারাত্মক পর্যায়ের দয়িফ হলে একশ দয়িফ মিলেও হাসান পর্যন্ত উন্নীত হবে না। এই আলোকে আমরা উল্লিখিত দুটো হাদিসের প্রথমটায় একাধিক সমস্যা দেখেছি। আবার সমস্যাগুলোও অনেক গভীর, যা দূর করাও সম্ভব নয়। এ জন্য অনেকে হাদিসটাকে মুনকার পর্যন্ত বলেছেন। ফলে এটা অন্য একটা দয়িফকে শক্তিশালী করার যোগ্যতা রাখে না। দ্বিতীয়ত, একাধিক দয়িফ মিলে হাসান হওয়ার মানে হলো, একই হাদিস একাধিক দয়িফ সূত্রে (সনদ) বর্ণিত হওয়া। চাই মুতাবি হোক বা শাহিদ (একই হাদিস একজন সাহাবি থেকে ভিন্ন ভিন্ন সনদে বর্ণিত হলে প্রতিটি সনদকে অপরটির জন্য মুতাবি, আর একই হাদিস একাধিক সাহাবি থেকে ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হলে একটিকে অপরটির শাহিদ বলা হয়)।

উসুল হলো, একই হাদিস একাধিক দয়িফ সূত্রে বর্ণিত হলে একটার দ্বারা আরেকটা শক্তিশালী হয়ে যায়, অথচ উল্লিখিত হাদিসদুটো এক নয়; বরং ভিন্ন। কারণ, প্রথম হাদিসে বলা হয়েছে—যে ব্যক্তি কোনো মহিলার গোপনাঙ্গে দৃষ্টি দিলো, তার জন্য ওই মহিলার মা ও মেয়েকে বিয়ে করা বৈধ নয়। আর দ্বিতীয় হাদিসে বলা হয়েছে, ‘এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, “হে আল্লাহর রাসুল, আমি জাহিলি যুগে এক মহিলার সাথে যিনা (ব্যভিচার) করেছিলাম। এখন কি ওর মেয়েকে বিয়ে করতে পারব?” জবাবে তিনি বললেন, “আমি এটা বৈধ মনে করি না। আর তা বৈধ হওয়ার উপযুক্তও নয় যে, মহিলাটির যে বিষয়টা তুমি জেনেছ, বিয়ে করে তার মেয়েরও সে বিষয়টা তুমি জানবে।” এখানে দেখা যাচ্ছে, উভয় হাদিসের ঘটনা এক নয়; বরং দুটো ভিন্ন হাদিস। আবার, প্রথম হাদিসে মহিলার গোপনাঙ্গে দৃষ্টি দেয়ার কারণে হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে, আর পরের হাদিসে যিনা করার করার কারণে হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে। যেহেতু দুটো হাদিস এক নয়; উপরন্তু প্রথমটা মুনকার পর্যায়ের দয়িফ, তাই এখানে হাসান সাব্যস্ত হওয়া সম্ভব নয়। আর এটা দ্বারা একটি বিধান সাব্যস্ত করতে গেলে আল্লাহর বাণী ‘উল্লেখিত নারীরা ছাড়া অন্য নারীকে তোমাদের জন্য বৈধ করা হলো।’-এর সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে যাবে।

প্রথম মতের চতুর্থ দলিল হিসেবে সাহাবি ইমরান ইবনু হুসাইন থেকে যে আসারটি পেশ করা হয়েছে, এটা মাওকুফ বর্ণনা (একজন সাহাবির উক্তি), তাও আবার দয়িফ। আর এটা সায়িদ ইবনু আবি আরুবাহ কর্তৃক বর্ণিত, যিনি ‘মুখতালাত’ রাবি। এমন রাবির বর্ণনা অন্য বর্ণনাকে শক্তিশালী করে না। তদুপরি সায়িদ ইবনু আবি আরুবাহ সাহাবি ইবনু আব্বাস থেকে এর বিপরীত বর্ণনাও করেছেন, যা আমরা দেখেছি। তাই এটাও দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।

দ্বিতীয় মতের পক্ষে প্রথম দলিল হিসেবে যে আয়াত পেশ করা হয়েছে, সেটি অকাট্য প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

তাঁদের দ্বিতীয় দলিল হিসেবে ‘হারাম বিষয় হালালকে হারাম করে না’ মর্মে যে হাদিসটা পেশ করা হয়েছে, সেটার ভিন্ন ভিন্ন ৩টি সনদ আমরা দেখেছি— যার ২টি মারফু (সরাসরি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলিহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত), আর ১টি মাওকুফ, যা আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুর বক্তব্য হিসেবে বর্ণিত। প্রথম বর্ণনাটি সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত; এর সনদে হালকা সমস্যা রয়েছে। যে রাবির কারণে এতে দুর্বলতা সৃষ্টি হয়েছে, তাকে অনেকেই দয়িফ বলেন না। এ জন্য দেখা যায় অনেক আলিম তাঁদের লিখনিতে উক্ত হাদিসটি দলিল হিসেবে উপস্থাপন করেন। দ্বিতীয় বর্ণনাটি আয়িশাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত। এটা দয়িফ জিদ্দান (মারাত্মক পর্যায়ের দয়িফ), যা প্রথম বর্ণনাকে শক্তিশালী করার যোগ্যতা রাখে না। আর তৃতীয়টি আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুর বক্তব্য, যা ইবনু শিহাব যুহরি (রাহিমাহুল্লাহ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম যুহরি যেহেতু আলিকে পাননি, তাই এটা মুরসাল হিসেবে দয়িফ।

তৃতীয় দলিল হিসেবে আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর দুইটি বক্তব্য পেশ করা হয়েছে, যা তাঁর থেকে ভিন্ন দুই সনদে বর্ণিত। প্রথমটি কাতাদাহ এবং দ্বিতীয়টি আতা (রাহিমাহুমাল্লাহ) বর্ণনা করেছেন। তার মাঝে আতার বর্ণিত আসারটিই সর্বাপেক্ষা সহিহ।

উক্ত দলিলগুলো সামনে রাখলে যা স্পষ্ট হয়—ইমাম আবু হানিফাহ ও আহমাদ রাহিমাহুমাল্লাহর মতের পক্ষে যেসব প্রমাণ পেশ করা হয়েছে, এর একটাও প্রামাণ্য হিসেবে যথেষ্ট (সহিহ) নয়; বরং ইমাম শাফিয়ি ও মালিক রাহিমাহুমাল্লাহর পক্ষে পেশকৃত প্রথম আয়াত এবং শেষোক্ত সহিহ আসারটিই প্রামাণ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। আর অনেকেই তাঁদের দ্বিতীয় দলিলটিকে এর হালকা দুর্বলতার কারণে সহযোগী প্রমাণ হিসেবে পেশ করে থাকেন।

তাই দলিলের আলোকে ইমাম শাফিয়ি ও মালিক রাহিমাহুমাল্লাহর মতটাই বিশুদ্ধ ও অগ্রগণ্য প্রমাণিত হয়। অর্থাৎ যিনা, স্পর্শ ও গোপনাঙ্গে দৃষ্টি দেয়ার দ্বারা হুরমাত সাব্যস্ত হয় না। ফলে যিনাকারী পুরুষ ও মহিলা একে অপরের মাহরাম আত্মীয়কে বিয়ে করতে পারবে। প্রাসংগিকভাবে উল্লেখ্য, নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্মতিতে যিনা করলে যেমন হুরমাত সাব্যস্ত হয় না, তেমনি ধর্ষণের কারণেও হবে না। উদাহরণত, বর্তমান নষ্ট সমাজের যে চিত্র আমরা দেখতে পাই যে, শশুর পুত্রবধূকে, জামাই তার শাশুড়িকে, বেয়াই নিজ বেয়াইনকে, বাবা তার মেয়েকে ধর্ষণের ঘটনা প্রায়ই শোনা যায় (আল্লাহর কাছে গযব থেকে আশ্রয় চাই!)। এসব কারণে ধর্ষক এবং ধর্ষিতাদের বৈবাহিক সম্পর্কের কোনো ক্ষতি হবে না এবং নতুনভাবে কোনো হুরমাতও সাব্যস্ত হবে না।

____

[১] সুরা আন-নিসা, ৪ : ২৩

[২] সুরা আন-নিসা, ৪ : ২৩

[৩] সুরা আন-নিসা, ৪ : ২৩

[৪] সুরা আন-নিসা, ৪ : ২২

[৫] সুরা আন-নিসা, ৪ : ২৩

[৬] সুরা আন-নিসা, ৪ : ২২

[৭] সুরা আন-নিসা, ৪ : ২৩

[৮] মুসান্নাফু ইবনি আবি শাইবাহ, হাদিস নং : ১৭০১৩

[৯] সিলসিলাহ দয়িফাহ, হাদিস নং : ৬১১০

[১০] মুসান্নাফু আবদির রাযযাক, হাদিস নং : ১৩৬৭৭

[১১] মুসান্নাফু ইবনি আবি শাইবাহ, বর্ণনা নং : ১৭০১০

[১২] মুকাদ্দিমাতু ইবনিস সলাহ, আন-নাওয়ুস সানি ওয়াস সিত্তুন, পৃষ্ঠা : ৩৯২

[১৩] মুসান্নাফু ইবনি আবি শাইবাহ, হাদিস নং : ১৭০১১

[১৪] সুনানু ইবনি মাজাহ, হাদিস নং : ২০১৫

[১৫] আল-মুজামুল আওসাত, হাদিস নং : ৪৮০৩

[১৬] ইমাম বাইহাকি, আস-সুনানুল কুবরা, হাদিস নং : ১৩৯৬৩

[১৭] মুসান্নাফু আবদির রাযযাক, হাদিস নং : ১৩৬৬২

[১৮] ইবনু রজব হাম্বলি, শারহু ইলালিত তিরমিযি, খণ্ড : ২, পৃষ্ঠা : ৬৯৮

[১৯] মুসান্নাফু ইবনি আবি শাইবাহ, হাদিস নং : ১৭১৪০

Leave a Reply